রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

করোনার বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে নেমেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের একদল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। মৃত্যুর দুয়ার থেকে করোনা আক্রান্তদের ফিরিয়ে এনে তারাই এখন ‘সত্যিকারের হিরো’।

কিন্তু এইসব মানুষ কঠিন এই লড়াইয়ে নেমেছেন যৎসামান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিয়েই। আগে আইসোলেশন সুবিধা থাকলেও এখন নেই। ফলে দিন শেষে ফিরছেন পরিবারের কাছে। কেবল নিজের নয়, পরিবারকেও ফেলছেন ঝুঁকির মুখে।

এখন করোনার হটস্পট রাজশাহী। করোনা সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিনই রামেক হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন রোগী। ৩০৯ শয্যার করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে শুক্রবার (১৮ জুন) সকাল ৯টা পর্যন্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন ৩৪৯ জন।

২০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ১৯ মুমূর্ষু রোগী। বিপুলসংখ্যক রোগী আইসিইউর অপেক্ষায় রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় আইসিইউতেই মারা গেছেন ৪ জন। একই সময়ে করোনা ইউনিটের অন্য ৬ ওয়ার্ডে মারা গেছেন আরও ৮ রোগী। ১৫ দিনে মৃত্যু ছাড়িয়েছে দেড় শতাধিক।

রামেক হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের নেই আইসোলেশন ব্যবস্থা

গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪১ জন। অবস্থা গুরুতর না হলে হাসপাতালে ঠাঁয় মিলছে না। তারপর অক্সিজেন-শয্যা না পেয়ে কাতরাচ্ছেন হানসপাতালে আসা লোকজন। মৃত্যু এখানে নিয়মিত ঘটনা। এখানে নিঃশব্দে প্রাণ আসে, প্রাণ যায়।

সব মিলিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি করোনা ইউনিটে। সেই মৃত্যুপুরীতে জীবন বাঁচাতে আসা রোগীরা সৃষ্টিকর্তার পরেই বিশ্বাস করছেন চিকিৎসকদের। কিন্তু পর্যাপ্ত সুরক্ষা না থাকায় কিছুটা ভীতি আছে চিকিৎসক-নার্সদেরও। তবুও রোগীদের কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সেবার হাত বাড়িয়ে।

এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি থাকছেই বলে জানিয়েছেন করোনা ইউনিটে দায়িত্বরক চিকিৎসক ও নার্সরা। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স বলেন, করোনা সংক্রমণের শুরুতে রামেক হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের আইসোলেশন ব্যবস্থা ছিল, ছিল থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমানে সেই ব্যবস্থা নেই। খাবার-সুরক্ষা নিজ দায়িত্বে করছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। 

তারা বলেন, সুরক্ষায় মেডিকেল থেকে শুধু মাস্ক ও পিপিই দেওয়া হচ্ছে। সেটিও পর্যাপ্ত নয়। অনেক সময় রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে পিপিই পরার সময় পাওয়া যায় না, তখন শুধু মাস্ক আর ফেসশিল্ড পরেই ছুটে যেতে হয় রোগীর কাছে।

খাওয়ার ব্যবস্থা নিজের দায়িত্বে করতে হয় চিকিৎসকদের। এক্ষেত্রে যেসব চিকিৎসকের বাসা হাসপাতালের আশেপাশে তারা বাড়ি থেকেই খাবার নিয়ে আসেন। আর যারা দূরে থাকেন তারা হাসপাতালের ক্যানটিন অথবা কোনো রেস্তোরাঁ থেকে অর্ডার করে খাচ্ছেন।

থাকার বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় ডিউটি শেষে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই পরিবারের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে। সতর্কতার সঙ্গে পরিবারে থাকছে করোনা চিকিৎসায় দায়িত্বরত অনেক চিকিৎসক।

চিকিৎসকরা আরও জানান, পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না, দু-একদিন পরপরই ওয়ার্ড বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। সেটাও রোগীতে পরিপূর্ণ হতে সময় লাগছে না। রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু তাদের পিছু হটার সুযোগ নেই।

তারা জানাচ্ছেন, হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে। সাধারণ অক্সিফ্লোমিটার সংকট রয়েছে। ভেন্টিলেটর থাকলেও মাস্ক নেই। এতো কিছুর সংকট নিয়েও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকগণ।

রামেক হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, সিনিয়র-জুনিয়র মিলে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করছেন২৫২ জন চিকিৎসক। চিকিৎসকই নন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কোর্স শিক্ষকরাও যুক্ত হচ্ছেন চিকিৎসায়।

রামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্বপালন করছেন ৫৮০ জন নার্স এবং ১৫২ চিকিৎসাকর্মী। চিকিৎসকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। তবে দায়িত্বপালনে এসে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন সম্মুখসারির এসব যোদ্ধা।

হাসপাতালের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত করোনা ইউনিটের ১২৩ জন চিকিৎসকের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে করোনার প্রথম ঢেউয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১২০ জন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনা ধরা পড়েছে ৩ জনের মতো চিকিৎসকের।

অন্যদিকে, করোনার প্রথম ঢেউয়ে এই ইউনিটের ২৬৭ জন নার্সের করোনা শনাক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৫৭ জন নার্স। চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে মাত্র ৬ জনের করোনা ধরা পড়েছে দ্বিতীয় ঢেউয়ে। এছাড়া আরও ১০১ জনের করোনা শনাক্ত হয় প্রথম ঢেউয়ে।

করোনা ইউনিটের চিকিৎসক-নার্সদের আইসোলেশন সুবিধা বাতিল করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। তিনি বলেন, সংক্রমণের প্রথম দিকে ব্যাপকহারে চিকিৎসক-নার্সরা সংক্রমিত হচ্ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, ওই সময় দায়িত্বরতদের আলাদা আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে সবাইকে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। ফলে সংক্রমণ নেই বললেই চলে। আর এই কারণেই আইসোলেশন সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।

এমএসআর