সেলুনে অপেক্ষার সময়টুকু যেন অলস না কাটে তাই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন হারুন অর রশীদ। সেলুনে বসে পড়া যাবে বই, ছড়াবে জ্ঞানের আলো- এমন ধারণা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেলুনভিত্তিক পাঠাগার গড়ে তুলছেন তিনি।

পেশায় ব্যাংকার এই যুবকের স্বপ্ন দেশের সব জেলায় অন্তত একটি করে সেলুনভিত্তিক পাঠাগার গড়ে তোলার। এতে করে বইয়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসা তৈরি হবে। ইতোমধ্যে তার প্রচেষ্টায় দেশের তিনটি জেলায় চারটি সেলুনভিত্তিক পাঠাগার গড়ে উঠেছে। ব্যতিক্রমী এসব পাঠাগার নজর কাড়ছে পাঠকসহ সবার।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া গ্রামের মৃত আসাদুল্লাহ ও সুফিয়া আক্তার দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় হারুন। বর্তমানে তিনি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শাখায় জ্যেষ্ঠ কেন্দ্র ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। নিজে দুটি বইও লিখেছেন। একটির নাম ‘উনত্রিশ’ এবং আরেকটি ‘ইস্কাপনের টেক্কা’।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার আফতাব উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিক ও ২০০১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আব্দুস ছাত্তার ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন হারুন। এরপর তিনি বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

মূলত কলেজে অধ্যয়নের সময় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদুল ইসলামের মাধ্যমে বইয়ের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয় হারুনের। কলেজের হোস্টেলে অধ্যাপক মাকসুদুল ইসলামের পাশের কক্ষেই থাকতেন হারুন। তখন হারুনকে পড়ার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই দিতেন অধ্যাপক মাকসুদুল।

পরবর্তীতে পড়াশোনা শেষ করে ২০০৭ সালে নিজের বাড়িতে একটি পাঠাগার গড়ে তোলেন হারুন। বর্তমানে ওই পাঠাগারে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের অন্তত দুই হাজার বই রয়েছে। তবে পাঠাগার গড়ে তোলার আগ থেকেই বই সংগ্রহের কাজ শুরু করেন হারুন। সংগৃহীত বইগুলো তিনি গ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তাদের পড়ার জন্য দিতেন। এভাবে তিনি বই পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতেন।

হারুন জানান, গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার নবাবগঞ্জের কলাকোপা বাজারের একটি সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় তাকে। তখন তার মাথায় আসে- সেলুনে এসে অনেককে চুল-দাড়ি কাটার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষার এই সময়ে বই পড়লে সময়ও কাটবে আবার জ্ঞানও অর্জন হবে। সেই থেকে সেলুনভিত্তিক পাঠাগার করার পরিকল্পনা করেন হারুন।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা বাজারের সুব্রত হেয়ার কাটিং সেলুনে প্রথম সেলুনভিত্তিক পাঠাগার করেন। এরপর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার কুলিয়ারচর বাজারের নিখিল হেয়ার কাটিং ও বিজয় হেয়ার কাটিং সেলুনে আরও দুটি পাঠাগার স্থাপন করেন। 

সর্বশেষ গত মে মাসের শেষ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার প্রত্যন্ত অরুয়াইল বাজারে নকুল ফ্যাশন হেয়ার কাটিং সেলুনে আরেকটি পাঠাগার গড়ে তুলেন হারুন। সেলুনগুলোর ভেতরে একপাশে ছোট আকারে পাঠাগার করা হয়েছে। প্রতিটি পাঠাগারে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের দুই শতাধিক করে বই রয়েছে।

অনেকেই কৌতুহল নিয়ে সেলুনভিত্তিক পাঠাগারগুলোতে আসছেন। চুল-দাড়ি কাটতে এসে অপেক্ষার সময়টুকু বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করছেন। সেলুন মালিকরাও হারুনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা বাজারের সুব্রত হেয়ার কাটিং সেলুনের স্বত্বাধিকারী সুব্রত শীল বলেন, দোকানের ভেতরে পাঠাগারের জন্য জায়গা দিয়েছি। এই পাঠাগার ভালোই সাড়া ফেলেছে। আমার কাছেও বিষয়টি ভালো লাগছে। চুল-দাড়ি কাটতে এসে এখন আর কাউকে অলস সময় কাটাতে হয় না। বইয়ের তাক থেকে বই নিয়ে পড়ে সময় কাটান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল গ্রামের সমাজকর্মী মো. মনুসর আলী বলেন, ‘প্রত্যন্ত অরুয়াইলে করা সেলুনভিত্তিক পাঠাগারটি গ্রামের তরুণ এবং সাহিত্য মনস্কদের কাছে টানছে। অনেকেকেই দেখি সেলুনে গিয়ে বই পড়ছে। আমি নিজেও ওই পাঠাগারে গিয়ে বই পড়েছি। এভাবে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হলে তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হবে না’।

সেলুনভিত্তিক পাঠাগারের উদ্যোক্তা হারুন অর রশীদ বলেন, আমার প্রতিবেশী এক অবসরপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা প্রায়ই আমার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তেন। একটি বই ফেরত দিয়ে আবার আরেকটি বই নিয়ে যেতেন। এটা দেখেই মানুষকে বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করার কথা আমার মাথায় আসে। যারা বই পড়তে ভালোবাসে, আমি তাদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসতাম।

তিনি আরও বলেন, সেলুনে তরুণ প্রজন্মের অনেকে আসে। তারা ইচ্ছে করলে সেলুনে বসে বই পড়তে পারে। সেই থেকেই সেলুনভিত্তিক পাঠাগার করার পরিকল্পনা করি। সেলুন মালিকদের রাজি করিয়ে নিজের অর্থায়নেই পাঠাগারগুলো করেছি। এভাবে দেশের প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে হলেও সেলুনভিত্তিক পাঠাগার করতে চাই।

এসপি