বাবাকে নিয়ে ৪ সন্তানের ভাবনা
বাবা শুধু একজন জন্মদাতা, ভরণপোষণকারী কিংবা অভিভাবকই নন, বাবা মানে চওড়া কাঁধ আর শক্ত হাতের মুঠো। বাবা মানে আশ্রয়-প্রশ্রয় আর শত শাসনের পরও যেন নীরব ভালোবাসা। বাবা দিবসে নিজের বাবাকে নিয়ে কয়েকজনের অভিব্যক্তি জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট। তারা রোমন্থন করেছেন বাবাকে নিয়ে তাদের মধুর স্মৃতি।
বাবা হলেন কাছের বন্ধু
ময়মনসিংহের কলেজপড়ুয়া আতিয়া ফারজানা অর্পার চোখে বাবা মানে একটি বটবৃক্ষ। যিনি মাঝখানে থেকে পুরো পরিবারকে ছায়া দেন, আগলে রাখেন। অর্পার ভাষ্য, প্রতিটি মেয়ের জীবনে প্রথম পুরুষ তার বাবা। যিনি ছোটবেলা থেকেই তার মেয়েকে সব বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখেন। মানুষের যেমন নিশ্বাস ছাড়া চলে না, একটি মেয়ের কাছে তার বাবা ছাড়া সে রকম নিশ্বাস শূন্য লাগে। নদী যেমন প্রবহমান, ঠিক মা-বাবার প্রতি সন্তানের আবেগ-অনুভূতিও তেমনি প্রবহমান।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, আমার প্রতিটি ইচ্ছা আর চাওয়া বাবার কাছেই। আমার অন্যায় আবদারগুলো খুব সহজেই মেনে নেন বাবা। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার চাকরিজীবী বাবা অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে একটা বিস্কুট ও আইসক্রিম কিনে দিতেন। এটা কোনো দিন বাবার ভুল হয়নি। এখন নিজে যখন আইসক্রিম খেতে যাই, সেই স্মৃতিটা মনে ভেসে ওঠে। আমার বাবা হলেন আমার বন্ধুর মতো। যার সঙ্গে আমি নির্দ্বিধায় সবকিছু বলতে পারি। এখনো পাশাপাশি দুজন বসে কফি খাওয়া, আমার কাছে সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত।
বাবা মানে অন্ধকারে আলোর দিশা
প্রথমবারের মতো কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন স্কুলশিক্ষক মোকাদ্দেছ উর রহমান। প্রত্যেক পুরুষের কাছে এ এক নতুন এবং জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতাটাই বাবাকে নতুন করে অনুভব করতে শেখায়। তিনি বুঝতে পারেন, তার বাবা কেন তার শেষ সম্বলটুকু দিয়ে হলেও সন্তানের আবদার পূরণ করতে চাইতেন। সন্তানের হাসিতেই বাবার যেন পরম শান্তি।
বিজ্ঞাপন
মোকাদ্দেছের মতে, বাবা মানেই আপনজন, সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা। বাবা মানেই প্রখর রোদে শীতল ছায়া, অন্ধকারে আলোর দিশা।
তিনি বলেন, একটা মানুষ কত বেশি নীতিবান, নিঃস্বার্থ, ধৈর্যশীল ও উদার হতে পারেন, তা আমার বাবাকে দেখলেই বোঝা যায়। সেই ছোটকাল থেকেই যে বাবাকে দেখে আসছি, আজও তিনি তেমন। আমার কাছে আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতাও বটে। সবাইকে ভালো রাখার জন্য তিনি আপ্রাণ অভিনয় চালিয়ে যান। সবার জন্য সবকিছুই করা হয় কিন্তু নিজের জন্য তেমন কিছুই করা হয়ে ওঠে না। তবু কখনো বলা হয়নি ‘অনেক ভালোবাসি বাবা’।
বাবারা হলেন ‘ঈশ্বরে’র প্রতিনিধি
প্রত্যেক মেয়ের স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তনশীল। একটা সময় পর তাদের বাবার বাড়ি থেকে যেতে হয় স্বামী-সংসারে। এর ব্যতিক্রম নন সাদিয়া জামানও। ১২ বছর আগে এই নিয়মেই চলে যেতে হয়েছে তার আসল ঠিকানায়। সেই দিনটায় অঝোরে কেঁদেছিলেন তার বাবা। এক যুগ পরেও সেই স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি সাদিয়া।
স্মৃতির কপাট খুলে সাদিয়া জামান বলেন, চাকরি সূত্রে বাইরে থাকার কারণে আমি বাবার সান্নিধ্য পেয়েছি কম। ছোটবেলায় তো মানতেই পারতাম না কেন বাবার চাকরি করতে হয়। দুই কি তিন মাস পরপর ছুটিতে বাড়ি আসতেন। কখনো তিন-চার মাসও পেরিয়ে যেত। আমি আব্বাকে খুব মিস করতাম। প্রতিবেশী টুম্পার বাবা রোজ তাকে সাইকেলে চড়িয়ে স্কুলে দিয়ে আসতেন। তখন কী যে কান্না পেত আমার! মায়ের সঙ্গে আমিও চিঠি লিখে একই খামে ভরে পাঠিয়ে দিতাম। আব্বা নাকি আমার ওই ছোট চিঠি পড়ে কাঁদত! আবার খুলে খুলে বারবার পড়ত।
তিনি আরও বলেন, সেদিনও আব্বা কেঁদেছিলেন। আমাকে জাপটে ধরে কেঁদেছিলেন। যেদিন আমি আব্বাকে ছেড়ে, আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। শেষবার যখন গাড়ির কাঁচের জানালা পেরিয়ে আব্বার দিকে তাকিয়েছিলাম, দেখি ছোট বাচ্চার মতো অঝোরে কাঁদছেন পাথরের মতো শক্ত মানুষটা। এখনো যখন খারাপ সময়ে বাবার ফোনে দিই। ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই আব্বা বুঝে যান আমি ভালো নেই। এ যেন বাবাদের অদৃশ্য এক শক্তি। বাবারা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি।
বাবার স্মৃতিকে পুঁজি করেই জীবনের মানে খুঁজি
বাবাকে নিয়ে সব সময় মুগ্ধতা কাজ করে, তার গভীর জীবনবোধ বিহ্বল করে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্রী আহনাফ তাহমীদ নেফারতিতিকে। তার কাছে বাবা মানে গোটা একটা ছায়াপথ। বাবা মানেই হিমালয়। বাবা মানেই বিশাল আকাশ।
১২ বছর আগে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন বাবাকে হারান নেফারতিতি। তবুও বাবার স্মৃতিই আষ্টেপুষ্টে জড়িয়ে আছে তার মনে। বাবার সঙ্গে কাটানো ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে যেন স্বপ্নের মতো অনুভূতি হয় তার।
আলাপকালে সেই ছোট্টবেলায় ফিরে যান নেফারতিতি। বলেন, বাবার সঙ্গে ঘুমালে বালিশের দরকার হতো না। বাবার বাহুতেই মাথা রেখে ঘুমাতাম আর রাজ্যের সব গল্প করতাম। প্রতিদিন বিকেল হলেই রেললাইন ধরে হাঁটতাম আমরা কিংবা ঘুরে বেড়াতাম শহরের অলিগলি। কত রকম মানুষ যে দেখতাম!
তিনি বলেন, বাবা আমাকে ছোট থাকতেই ‘জীবন’ কী, তা উপলব্ধি করাতে চাইতেন। একদিন ঝুমবৃষ্টিতে মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাকে কাঁধে নিয়ে বের হয়ে গেছিলেন। পুরো শহর ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। ভিজতে আর পানিতে খেলতে পেরে আমার খুশি দেখে কে! সারাদিন টইটই করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মায়ের খুব বকুনি খেয়েছিলাম দুজনই। তবু সেদিনের দুর্দান্ত খুশি এতটুকু ম্লান হয়নি। বাবাকে যেদিন কবর দেওয়া হলো, সেদিনও তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল। একটা গোটা ছায়াপথ যেন মাটিচাপা পড়ে গেল।
আহনাফ তাহমীদ নেফারতিতি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বাবার সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তার শ্রেণিনির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে মেশা আর রোজ বই পড়ার অভ্যাসের দিকটা আমি আজও অনুসরণ করি। বাবাকে বোঝার বয়স হওয়ার আগেই উনি চলে গেলেন। বাবার স্মৃতিকে পুঁজি করেই আজও জীবনের মানে খুঁজে চলি...।
এনএ