নীলফামারীর সৈয়দপুর বাস টার্মিনালে সকাল থেকে শুরু হয় কর্মচাঞ্চল্য। কেউ বাস ধোয়ার কাজে ব্যস্ত, আবার কেউ গাড়ির নিচে শুয়ে তেল-গ্রিজ মাখেন, কেউবা হাঁকডাক দিয়ে যাত্রী ডাকেন। এই টার্মিনাল দিয়ে প্রতিদিন জেলা ও আন্তঃজেলা রুটে শতাধিক বাস চলাচল করে। টার্মিনালের ভিড়ের মাঝেই দেখা যায় পঞ্চাশোর্ধ্ব জাবেদ আলী (৫২) নামে এক হেলপার বাসে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছেন।

জাবেদ আলী সৈয়দপুর মতিরমোড় এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় এক বাসের হেলপার। তার বাবা ছিলেন বাসচালক। ছোটবেলায় অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। বাবা সকালে বের হলে রাতে ফিরতেন। সংসারের হাল ধরতে ছোটবেলাতেই বাবার সঙ্গে হেলপারি শুরু করেন। ভেবেছিলেন কিছুদিন পর স্কুলে ফিরবেন, কিন্তু আর ফেরা হয়নি। তরুণ বয়সে বিয়ে করেন, ভেবেছিলেন নিজের কষ্টের গল্প যেন সন্তানদের জীবনে না আসে। স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াবেন, কিন্তু হেলপারি করে উপার্জন করা টাকায় পড়াতে পারেননি তিনি।

জাবেদ আলীর স্ত্রী ও দুই সন্তান। মেয়ে কলেজে পড়ত, এখন আর যায় না। বই-খাতা কেনার টাকাও দিতে পারেননি। বাসে শুধু জাবেদ আলী নয়, এমন সব হেলপারই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শুধু যাত্রী ডাকাই নয়, রয়েছে অনেক ঝুঁকি। হঠাৎ ব্রেক কিংবা সড়কে দুর্ঘটনায় আহত হন তারা। দুর্ঘটনায় আহতদের বাস মালিকরা তেমন সহায়তা না করলেও ধার-দেনা করে তাদের চিকিৎসা করাতে হয়।

বাবার বাসের স্টিয়ারিং এখন ছেলের হাতে

বাবার সঙ্গে পরিবহন পেশায় ফেরেন মনোয়ার হোসেন নামে আরেক বাসচালক। শুরুতে যুক্ত হন বাসের হেলপার হিসেবে। পরে কিছুদিন থাকার পর শুরু করেন বাস চালানো। স্কুলে থাকার বয়সে এসেছেন বাস শ্রমিকের কাজে, মাঝেমধ্যে এসব স্মৃতি মনে করে কাঁদেন। দৈনিক ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা রোজগার হয় তার, সেটি দিয়ে পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানোর চেষ্টা করছেন।

মনোয়ার হোসেন সৈয়দপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে চিলাহাটি ও রংপুর রুটের নিয়মিত বাসচালক। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় একটি বাসের চালক। বাবার হাত ধরে পেশায় এসে তিনিও এখন চালক। শহরে প্রতিদিন শতাধিক বাস যাত্রীদের নিয়ে ছুটে চলে। সেই বাসের হেলপার, চালক, সহকারী—অনেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ পেশায় যুক্ত। তবে পাল্টায়নি জীবনের বাস্তবতা।

মনোয়ার হোসেন বলেন, আমি আগে পড়ালেখা করতাম, তবে পরিবারের অভাবের কারণে বাবার সঙ্গে এ পেশায় আসি। শুরুতে আমি বাসের হেলপার হিসেবে কাজ করি, পরে বাসের চালক হয়েছি। শুরুতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে, নতুন পেশায় এসে অনেক রাত নির্ঘুম কেটেছে। বংশপরম্পরায় এ পেশায় এসে অনেকে শুরুতে কম টাকায় কাজ শুরু করলেও পরে কিছু বেতন বেড়েছে। তবে দ্রব্যমূল্যের বাজারে সে টাকায় পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

আন্দোলন-ধর্মঘটে শ্রমিকদের বিপর্যস্ত জীবন

দেশের বিভিন্ন আন্দোলন-ধর্মঘটে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বাস শ্রমিকরা। দিনের পর দিন বাস চলাচল বন্ধ থাকার কারণে আর্থিক সংকটের পাশাপাশি নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা। হঠাৎ করে নানা পরিস্থিতিতে ধর্মঘট ডাকা হলে বাসের হেলপার, চালকদের আয় বন্ধ হয়ে যায়। দৈনিক মজুরিতে কাজ করা এসব শ্রমিকরা অনেক সময় না খেয়ে থাকেন। জীবন চালাতে তাদের ধারদেনা করতে হয়। ধর্মঘটের সময়ে বাস শ্রমিকদের কোনো সহায়তা কিংবা তহবিল না থাকার কারণে তাদের বিপাকে পড়তে হয়।

বাস শ্রমিক আলতাফ আলী বলেন, আমরা দৈনিক যা রোজগার করি, সেটা দিয়ে পরিবার চালাই। হঠাৎ করে ধর্মঘট হলে আমরা রাস্তায় বের হতে পারি না। বিপাকে পড়তে হয়, পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা

দৈনন্দিন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাস শ্রমিকদের হিমশিম খেতে হয়। দীর্ঘসময় পরিশ্রম করার পরও তাদের হাতে যথেষ্ট টাকা না থাকার কারণে পরিবারের চাহিদা মেটে না। ফলে দৈনিক বাজার করা যেন তাদের জন্য দুঃস্বপ্ন। বাস শ্রমিকেরা দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পান। কিন্তু বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে গরুর মাংস, মাছসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা সম্ভব হয় না। আগে বাজারে যা ২০০ টাকায় কেনা যেত, এখন সেটা ৪০০ টাকায় কিনতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন দামে বাস শ্রমিকদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। মালিকপক্ষের কাছে শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধিসহ সহায়তার দাবি জানিয়েছেন।

বাস শ্রমিক চন্দন রায় বলেন, আমরা যারা বাস শ্রমিক আছি, কষ্টে দিন পার করছি। আমাদের যে মজুরি দেওয়া হয়, সেটা দিয়ে পরিবার ভালোমতো চলে না।

সন্তানদের পড়ালেখা চালাতে হিমশিম

দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। এতে সবথেকে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন বাস শ্রমিকরা। সামান্য মজুরিতে যেখানে সংসার চালাতে হিমশিম, সেখানে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাস শ্রমিক কারিমুল বলেন, সারাদিন পরিশ্রম করে যা পাই, তা দিয়ে কোনোমতে টানাটানি করে সংসার চলে। সেখানে এক সন্তানকে স্কুলে পড়ালেখা করানো, তাকে নিয়মিত বেতন, বই-খাতা কিনে দিতে এখন কষ্ট হয়। আগে মাসের শেষে কিছু টাকা জমত, এখন সেটাও জমে না।

বাস শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও সেবা

বাসচালক, হেলপাররা চলছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্য দিয়ে। বিশ্রামের অভাব, বায়ু ও শব্দদূষণ এবং অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে শারীরিক নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাখতে হয় চালকদের। নিয়মিত ঘুম না হওয়ায় ক্লান্ত শরীর, চোখের জ্বালাপোড়া, বুক ও পিঠ ব্যথায় ভোগেন তারা। পরিবহন টার্মিনাল ও রাস্তায় দীর্ঘ সময় কাটানোর ফলে শ্রমিকদের ফুসফুসজনিত রোগ, কাশি, হাঁপানি, ত্বকের সমস্যা ও শ্রবণশক্তি হ্রাসের মতো সমস্যা দেখা দেয়। দুর্ঘটনায় আহত হলেও অনেকে নিজের খরচে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম খুবই সীমিত।

মানসিক চাপ

দীর্ঘ সময় রাস্তায় থাকা, পরিবারের সঙ্গে সময় না কাটাতে পারা, ট্রাফিক জ্যাম ও যাত্রীদের চাপ—এসব কারণে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কিছু ক্ষেত্রে মাদকাসক্তি ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে বাস শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাদের স্বাস্থ্য ও জীবনমান সুরক্ষিত না থাকলে এই খাতের স্থায়িত্বও হুমকির মুখে পড়বে। পরিবহন শ্রমিকদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা ক্যাম্প আয়োজন করা জরুরি।

বাস শ্রমিকদের প্রতি যাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রতিদিন বাসে লাখো মানুষ যাতায়াত করে। বাস শ্রমিকদের ছাড়া এ চলাচল সম্ভব নয়। তবে যাত্রী এবং বাস শ্রমিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা মতবিরোধ ও অভিযোগ রয়েছে। অনেক যাত্রীর অভিযোগ, শ্রমিকরা অনেক সময়ই খারাপ আচরণ করেন। তা ছাড়া, ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও গন্তব্যের আগে নামিয়ে দেওয়া। ভিড় বাসে যাত্রীদের প্রতি অসৌজন্যমূলক ব্যবহারও প্রায়ই চোখে পড়ে। অন্যদিকে বাস শ্রমিকদের দাবি, তারা দীর্ঘ সময় কাজ করেন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম পান না, আর চাপের মধ্যে কাজ করায় অনেক সময় আচরণে অসন্তোষ দেখা দেয়।

সৈয়দপুর বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা শ্রমিকদের খোঁজখবর রাখি, কিন্তু সীমিত সামর্থ্যের কারণে সবাইকে সহায়তা করা সম্ভব হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু থাকলে এসব শ্রমিকের জীবন কিছুটা স্বস্তির হতো। বাস শ্রমিকরা যেমন সমাজের অপরিহার্য সেবা প্রদানকারী, তেমনি যাত্রীরাও তাদের সেবার প্রধান অংশীদার। পারস্পরিক সম্মান, ধৈর্য ও সচেতনতা ছাড়া গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

এএমকে