সন্তানদের জন্য হলেও বেঁচে থাকতে চান এই রেমিট্যান্স যোদ্ধা

বিদেশে বসে স্বপ্ন দেখতাম ছেলে-মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করব। তবেই আমার রক্ত পানি করা শ্রম সার্থক হবে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, করোনায় চাকরি হারিয়ে দেশে পড়ে আছি অসুস্থ হয়ে। চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। বাচ্চাগুলাকে পড়াব কী, খাওয়াতেই তো পারি না ঠিকমতো।

এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছিলেন বাগেরহাটের শহরের পূর্ববাসাবাটি এলাকার রেমিট্যান্স যোদ্ধা (দুবাইফেরত) ইমরান পাইক মুক্তি (৫০)।

ইমরান পাইকের দুটি কিডনিই নষ্ট। অর্থাভাবে চিকিৎসাও বন্ধ। তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। মাত্র সাত মাসে ৬ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেও সুস্থ হতে পারেননি তিন সন্তানের এই জনক। এখন টাকার অভাবে ডায়ালাইসিসও বন্ধ তার। এ অবস্থায় সন্তানদের জন্য হলেও বেঁচে থাকতে চান এই রেমিট্যান্স যোদ্ধা।

বাগেরহাট শহরের পূর্ববাসাবাটি এলাকার আব্দুল হামিদ পাইকের ছেলে ইমরান পাইক মুক্তি। ২০০৮ সালে ধারদেনা করে দুবাই যান তিনি। কিন্তু বিধিবাম, পর্যটন ভিসা হওয়ায় কিছুদিন পালিয়ে থেকে বাড়িতে ফিরে আসেন। পরে বাবার জমি বিক্রি করে ধার শোধ করে ২০০৯ সালে আবারও তিন বছর মেয়াদি ভিসায় দুবাই যান ইমরান। পরে ১০ বছর কাজ করেন পালিয়ে থেকে। একপর্যায়ে বৈধ কাগজপত্র তৈরি করে ২০১৯ সালে ছুটিতে আসেন দেশে। কিছুদিন থেকে আবারও যান।

এবার আর ভাগ্য সহায় হয়নি ইমরানের। করোনায় কাজ বন্ধ থাকায় বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে ভরণপোষণ মিটিয়েছেন। শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে একেবারে দেশে ফিরে আসেন ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর। বাড়িতে পৌঁছানোর কয়েক দিন পরেই হয়ে পড়েন অসুস্থ।

পরে হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে চিকিৎসকরা জানান, তার দুটি কিডনিই নষ্ট। বাগেরহাট সদর হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা শেখ আবু নাসের বিষেশায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ হতে পারেননি ইমরান পাইক মুক্তি। সর্বশেষ তিন মাস ধরে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয় তাকে।

ইমরান পাইক মুক্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ থেকে ১১ বছর বিদেশে থেকেছি। কিছুই করতে পারিনি। করোনাকালে প্রায় এক বছর বেকার থেকে বাড়ি এসেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। ৬ থেকে ৭ মাসে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের ও পরিবারের সব শেষ করেছি। সর্বশেষ বাড়ির দুই কাঠা জমিও বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছি। প্রতি সপ্তাহে খুলনা আবু নাসের বিষেশায়িত হাসপাতালে দুবার ডায়ালাইসিস করি। ডায়ালাইসিস, ইনজেকশন, ওষুধ সব মিলিয়ে সপ্তাহে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়।

তিনি বলেন, টাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় গত সপ্তাহে ডায়ালাইসিস করতে পারিনি। তিনটি সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে খুব বিপদে রয়েছি। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই হয়তো বিদায় নিতে হবে পৃথিবী থেকে। জানি না আল্লাহ কী করবেন।

ইমরানের স্ত্রী আমেনা আক্তার লাকি বলেন, আমাদের এমন অবস্থা যে নবম শ্রেণিতে পড়া ছেলে আসিফ ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে আবিদা সুলতানার পড়াশোনা বন্ধ। ৯ মাস বয়সী মেয়েকেও একটু বাড়তি খাবার খাওয়াতে পারি না। স্বামীর চিকিৎসার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করেছি। বাবা, মা, ভাইসহ সব আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে কমবেশি টাকা ধার করিছি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন নিয়মিত ডায়ালাইসিসও করাতে পারছি না। সামনে কী করব, কিছুই জানি না।

প্রতিবেশী মনিরা পারভীন বলেন, তিনটি সন্তান নিয়ে ইমরান ও তার স্ত্রী যে কত কষ্টে দিন কাটান, তা না দেখলে বোঝা যায় না। প্রায় দিনই ঠিকমতো খেতে পারে না তারা। মাঝেমধ্যে আমরা যতটুকু পারি সহযোগিতা করি। যদি কোনো বিত্তশালী বা সরকারি কোনো সহযোগিতা এই পরিবার পেত, তাহলে পরিবারটি খুবই উপকার হতো।

বাগেরহাট পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের (পূর্ববাসাবাটি) কাউন্সিলর রেজাউর রহমান মন্টু বলেন, ইমরান পাইক যখন বিদেশে থাকতেন, তখন অবস্থাও মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমরা সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের বড় ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে হয়তো আল্লাহর রহমতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, ইমরান পাইকের বিষয়টি আমি শুনেছি। তার পরিবারকে সরকারি সহায়তার জন্য আবেদন করতে বলেছি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মের মধ্যে তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।

ইমরান পাইকের সঙ্গে ০১৭২৬-৪৬৪১৭৭ (বিক্যাশ) নম্বরে যোগাযোগ করতে পারবেন। মো. ইমরান পাইক মুক্তি, হিসাব নং : ১৫৩০৬, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, বাগেরহাট শাখা।

তানজীম আহমেদ/এনএ