চবি ছাত্রের মৃত্যু, এক বছরে দুই সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা-মা
যে সাকিব বাড়িতে ফিরলেই মা ডাক দিতেন, আজ সেই সাকিব আর কোনো শব্দ করছে না। বাড়ির উঠানে স্বজনদের ভিড়, ঘরের ভেতর কান্নার রোল। আর্তনাদ করে সাকিবের মা বলছিলেন, ছেলে আমার বড় অফিসার হইবো, কিন্তু কথা কয় না কেন? আমারে মা বলে ডাক দেয় না কেন? বাড়ি এলেই বলতো- মা, আপনার হাতের রান্নার স্বাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাই না। এখন আমি কার জন্য রান্না করমু? আমার সাকিব আমারে কিছু খেতে আর আবদার করবে না।
এভাবেই কথা বলছিলেন ফুটবল খেলতে গিয়ে আহত হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাকিবের মা রোজিনা আক্তার।
বিজ্ঞাপন
আরিফুল ইসলাম সাকিব নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চর হেয়ার গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝো। ঠিক এক বছর আগে সন্তান প্রসবের সময় সাকিবের একমাত্র বোন লিজা আক্তার সাথী মারা যান। এক বছরে দুই সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা-মা।
নাতির মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন সাকিবের দাদা-দাদি। সাকিবের অকাল মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও নেমেছে শোকের ছায়া। সহপাঠীরা হারিয়েছে একজন প্রাণবন্ত ও সদালাপী তরুণকে। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সকালে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সহপাঠীরা বলেন, সাকিব কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ফুটবল খেলতে নেমেছিলেন। তার অবস্থার অবনতি হলে তিনি কয়েকবার বমি করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকদের মতে, মাথায় সামান্য আঘাত থেকেও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে, এবং সেই রক্তক্ষরণেই সাকিবের মৃত্যু হয়েছে।
প্রায় এক বছর আগে প্রসব জটিলতায় গর্ভের নয় মাসের কন্যাসন্তানসহ প্রাণ হারানো লিজা আক্তার সাথীর কবরের পাশে সাকিবকেও দাফন করা হয়েছে। শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ ছড়িয়ে আছে পুরো বাড়িজুড়ে।
সাকিবের মা রোজিনা আক্তার বলেন, ছেলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বড় অফিসার হইতো, মানুষের সেবা করতো- এই স্বপ্নই দেখতাম রাইতে-দিনে। কিন্তু আজ এত মানুষ, এত কান্না… তবুও আমার সাকিব একটা শব্দও করে না। কথা কয় না কেন? মা বলে ডাক দেয় না কেন?
তিনি আরও বলেন, বাড়ি আসলেই দরজা দিয়া ঢুকতে ঢুকতেই বলতো- মা, তোমার হাতের রান্নার স্বাদ কোথাও পাই না। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবার ভালো লাগে না। এখন আমি কার জন্য রান্না করমু? আমার সাকিব আমারে আর আবদার করবে না। আমি রাইতে ভাবি- আমার ছেলে এখনো হাসতেছে, খেলতেছে… পরে মনে পড়ে- আমার ঘরের সোনা আজ আর শ্বাস নেয় না।
সাকিবের বাবা আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর আমার মাইয়াডারে মাটিতে দিলাম। এক বছরও যায় নাই- এই বছর আমার ছেলেডা। এক বছরে দুইটা সন্তানকে নিজের হাতে কবরে নামালাম। আল্লাহ মানুষে কতো পরীক্ষা দেন? বাবা-মায়ের বুক এভাবে ভাঙলে কি আল্লাহরও কষ্ট লাগে না? আমি সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায়।
এ সময় তিনি আর্তনাদ করে বলেন, আল্লাহ, আমারে নাও, আমি পারতেছি না আর। আমার বুক বড় ভারী হইয়া গেছে। আমারে ছাড়া অন্য কাউরে নিতে পারলেন না? আমার দুই চোখ আজ আমার দুই বাচ্চার জন্য পাথর হইয়া আছে। আমি শুধু সন্তান হারাই নাই- হারাইছি বাড়ির হাসি, আলো আর স্বপ্ন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাকিবের মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। উপাচার্য মহোদয় শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। এমন এক মেধাবী শিক্ষার্থী, যিনি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন- তার অকাল মৃত্যু আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আরও বেদনাদায়ক হলো, এক বছরের মধ্যে তার বাবা-মা দুই সন্তানের মৃত্যু বেদনা সহ্য করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হিসেবে আমরা তাদের পরিবারের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
হাসিব আল আমিন/এআরবি