৭৬ বছরের বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র দাস সবার কাছে ‘গলেয়া দাস’ নামেই পরিচিত। এই নামটার ভেতর লুকিয়ে আছে এক টুকরো ইতিহাস, এক জীবনের ত্যাগ, আর এক দীর্ঘ না-বলা কান্না। তিনি কোনো বড় পরিবারের সন্তান নন, ছিলেন না কোনো নামকরা স্কুলের ছাত্র। কিন্তু দেশের টানে, মানুষের মুক্তির স্বপ্নে, অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন যখন বয়স মাত্র ১৯।

১৯৫১ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের দেবীগঞ্জ বাজারে জন্ম রমেশ চন্দ্র দাসের। জন্মের আগেই বাবাকে হারান। শৈশব কেটেছে অভাব, অনাহার আর অসুস্থ মায়ের পাশে বসে। বড় ভাই ছিলেন প্রতিবন্ধী। সংসারে রোজগারের কেউ ছিল না। অনেক দিন এক বেলা খেয়েই পার করেছেন দিন। চিকিৎসার অভাবে চোখের সামনে মাকে হারিয়েছেন, তবু যুদ্ধের ডাক এলে পিছু হটেননি তিনি।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাখালের কাজ করে কোনো রকমে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। এরপর সংসারের ভার, মায়ের মৃত্যু আর অসহায় বড় ভাইকে অন্যের জিম্মায় রেখে একদিন আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমানের সঙ্গে পাড়ি জমান ভারতের থুকরাবাড়ি ক্যাম্পে। সেখানে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পাটাপাড়ায় আসার সময় ইন্ডিয়ান আর্মি তাদের আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। নাম ওঠে রেজিস্ট্রেশনের খাতায়। এরপর পাঠানো হয় মুজিব ক্যাম্পে।

টানা ২৮ দিনের কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে তিনি যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টরে চেংরা মাড়া টাউনের বুড়ি মাড়িহাট এলাকায়। উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশারের অধীনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। সেই যুদ্ধেই জন্ম নেয় একটি নতুন রাষ্ট্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে আসেন নিজ ভূমিতে। দেবীগঞ্জ বাজারে একটি ছোট সাইকেল মেকারের দোকান দেন। গড়ে তোলেন সংসার। দুই ছেলে, দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিলেও বড় মেয়ের স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি এখন বাবার বাড়িতেই থাকেন। বড় ছেলে বাস ও রেলস্টেশনে কুলির কাজ করেন। ছোট ছেলে ডিগ্রি পাস করেও চাকরির খোঁজে দপ্তর থেকে দপ্তর ঘুরে এখন মাঠে-খামারে শ্রম দেন। আর বাবা এই বয়সেও রাস্তার ধারে বসে অন্যের সাইকেল মেরামত করে সংসারের হাল ধরেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে গলেয়া দা পরিচিত মুখভরা হাসির মানুষ হিসেবে। রসিক, খোলা মনের, কারো কাছে কিছু চান না, কারো প্রতি রাগও নেই। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস আর দেশপ্রেমই তার সম্বল।

দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর অপেক্ষার পর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা চালু হলে তিনিও তা পেতে শুরু করেন। শুরুতে ছিল মাত্র কয়েকশ টাকা, বর্তমানে মাসিক ভাতা ২০ হাজার টাকা। যুদ্ধকালীন অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে একটি পাকা ঘরও নির্মাণ করে দেওয়া হয় তাকে।

তবু জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধটা আসে স্বাধীনতার বহু বছর পরে। ২০০২ সালে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার করা জমি-সংক্রান্ত মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই মামলা চালাতে গিয়ে ১৮ বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরেছেন। ঋণের পর ঋণ করে মামলা লড়তে লড়তে আজ সর্বস্বান্ত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছে গিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি, ফিরতে হয়েছে ছলছল চোখে। অবশেষে সেই মিথ্যা মামলার রায় আসে তার পক্ষে। কিন্তু ততদিনে জীবনটা ভেঙে পড়ে গেছে।

আব্দুল মান্নান নামে এক দোকানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গলেয়া দাকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। উনি কখনো কারো কাছে হাত পাতেননি। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, অথচ আজও রাস্তায় বসে সাইকেল মেরামত করেন—এটা আমাদের লজ্জা। উনি চাইলে অনেক কিছু চাইতে পারতেন, কিন্তু চাননি। এমন মানুষ এখন আর পাওয়া যায় না।’

স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা মানেই আমরা শুধু মঞ্চে দেখি, ছবিতে দেখি। কিন্তু গলেয়া দাস চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইতিহাস। ওনার জীবনের গল্প শুনলে গা শিউরে ওঠে। যুদ্ধ জিতেছেন, কিন্তু জীবনের কাছে প্রতিদিন হারছেন।’

স্থানীয় সংরক্ষিত আসনের ইউপি সদস্য ফুলজান বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা গলেয়া দা আমাদের এলাকার গর্ব। উনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, উনি জীবন্ত ইতিহাস। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কষ্টের কথা জানি। দীর্ঘদিনের মিথ্যা মামলায় উনি যে আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেটা খুবই দুঃখজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও যদি এই বয়সে তাকে রাস্তায় বসে সাইকেল মেরামত করতে হয়, তাহলে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করব যেন তার পরিবার অন্তত ন্যায্য সহায়তা পায়।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা গলেয়া দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যদি জানতাম মিথ্যা মামলার জন্য আমাকে ১৮ বছর কোর্টে ঘুরতে হবে, তাহলে যুদ্ধ করতে যেতাম না। খেয়ে না খেয়ে, ঋণ করে মামলা চালিয়েছি। এই মামলাতেই আমি মরে গেছি। দু'চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এখন এই বয়সে সাইকেল মেরামত করে মহাজনের টাকা শোধ করছি। যতদিন বাঁচব, ততদিন এই কাজই করে যাব।’

মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই চোখ ভিজে আসে তার। কাঁপা কণ্ঠে বলেন, ‘তখন দেশের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। একটা কণ্ঠস্বর শুনলেই বুক কেঁপে উঠত। রক্ত দিয়েছি, আরও দিতে রাজি ছিলাম শুধু মানুষকে মুক্ত করতে। আমরা মাঠে মার্বেল খেলছিলাম—আমি, কালিচরণ আর অতিকান্ত। তখনই একজন আনসার কমান্ডার এসে বললেন, দেশ রক্ষা করতে হবে। বাবাকে জন্মের আগেই হারিয়েছি। মা আমার খোঁজে কাঁদতে কাঁদতেই মারা গেছেন। মায়ের কথা মনে পড়লেই নিজেকে ধরে রাখতে পারি না।’

ঠাকুরগাঁও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের আহ্বায়ক মো. মীর জাহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র দাস ওরফে গলেয়া দার জীবন কেবল একটি ব্যক্তির গল্প নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের একটি বাস্তব চিত্র। যারা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাদের একজন যদি শেষ বয়সে এসে রাস্তায় বসে সাইকেল মেরামত করে জীবন চালাতে বাধ্য হন, তাহলে সেটা আমাদের সবার জন্য গভীর আত্মসমালোচনার বিষয়। যুদ্ধের সময় যেমন রাষ্ট্র তাদের পাশে চেয়েছিল, যুদ্ধের পরও তেমনি সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান কেবল ভাতা বা ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। তাদের জীবনের শেষ দিনগুলো যেন সম্মানের সঙ্গে কাটে এটাই আমাদের দাবি। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখবে এবং দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেবে।’

ঠাকুরগাঁও জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রমেশ চন্দ্র দাস একজন সত্যিকারের বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের মাঠে যেমন তিনি পিছপা হননি, যুদ্ধের পরের জীবনেও সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যদি শেষ বয়সে এসে এমন কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাতে হয় তাহলে সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু ইতিহাসের বইয়ে রাখার বিষয় নয়। যারা অস্ত্র হাতে দেশের জন্য লড়েছেন, তাদের জীবন ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দায়িত্ব। শুনেছি রমেশ চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জার। আমরা চাই, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যেন জীবনের শেষ সময়ে এসে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারেন। তার পরিবারের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হোক, আর্থিক জটিলতা ও ঋণের বিষয়গুলো মানবিক দৃষ্টিতে দেখা হোক।’

রেদওয়ান মিলন/এএমকে