‘১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ হন সহযোদ্ধা সর্দার মহিউদ্দিন। যুদ্ধের পর মহিউদ্দিনের মরদেহ নিয়ে আমিসহ কয়েকজন যোদ্ধা তার বাড়িতে যাই। বাড়ির আঙিনায় মহিউদ্দিনের মরদেহ রাখা হয়। তার ছোট্ট বাচ্চা বারবার মরদেহের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, “বাবা তোমার কী হয়েছে, তুমি চোখ মেলছো না কেন?”’

‘ওই অবুঝ শিশুটিকে আমি সেদিন সান্ত্বনা দিতে পারিনি। শিশুটি জানেও না কী অমূল্য ধন সে হারিয়েছে! কিন্তু আজও ওই শিশুটির করুণ আকুতি, মুখের ছবি-অভিব্যক্তি আমার মগজে ঘা মারে। ঘুমের মধ্যে আজও জেগে উঠি সেই স্মৃতি মনে পড়ায়।’

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে কথাগুলো বলতে বলতে আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫ নম্বর আসামি, যুদ্ধকালীন ৯নং সাব-সেক্টরের (বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল) কমান্ডার ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুল। গত ১১ ডিসেম্বর দুপুরে ফরিদপুর শহরের এক নম্বর গোয়ালচামট মহল্লার বাড়িতে বসে কথা হয় তার সঙ্গে।

বয়সের ভারে নুয়ে এসেছেন। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা ব্যাধি। ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারেন না। বেশির ভাগ সময় বাসাতেই শুয়ে-বসে কাটে দিন তার। তবে কোনো অনুষ্ঠানে, বিশেষত তা যদি হয় মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত, ডাক পড়লে একজন সহকর্মীর হাত ধরে উপস্থিত হন সে অনুষ্ঠানে।

নূর মোহাম্মাদের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেরার কুমারভুক গ্রামে। তার বাবা মরহুম আলহাজ তমিজউদ্দিন, মা মরহুম রাবেয়া খাতুন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

মা রাবেয়া খাতুনকে হারিয়েছেন ৭-৮ বছর বয়সে। ১৯৭২ সালে হজ করে ফেরার পথে জাহাজে মারা যান বাবা তমিজউদ্দিন। তার মরদেহ বাক্সে ভরে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নূর মোহাম্মাদ বিবাহিত এবং চার মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি মারা যান তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। মেয়ে সুলতানা পারভীনের বিয়ে হয়েছিল ফরিদপুর সদরের কোমরপুরে। তিনি মারা গেছেন। বাকি তিন মেয়ে বেঁচে আছেন। তারা হলেন-নাজনীন, কোহিনূর ও নাসরিন। একমাত্র ছেলে নাজমুল মোর্শেদ মাসুদ ব্যবসা করেন।

নাম নূর মোহাম্মদ হলেও ক্যাপ্টেন বাবুল নামেই তিনি পরিচিত ও সমাদৃত। মুক্তিযুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া এ উপাধি।

বয়স এবং রোগব্যাধির কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়লেও কণ্ঠে আজও বাজছে একাত্তরের রণহুঙ্কার। কথার মধ্যে অস্পষ্টতা থাকলেও গমগমে জ্বালাময়ী ভাবটা আজও বর্তমান।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নূর মোহাম্মদ বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। ওই দিন আমি নিজে রেসকোর্সে ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত ছিলাম। এরপর ২৬ মার্চ মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এসে থানা থেকে দুটি রাইফেল নিয়ে যুবকদের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি।

১৪ এপ্রিল পদ্মার চরে গিয়ে রাইফেল ফায়ারিং শুরু করেন নূর মোহাম্মদ। আগস্ট মাসে ভারতের মেঘালয় সেক্টর-২-এ যান। পরে ৯ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এম এ জলিল তাকে ফরিদপুরে পাঠান যুদ্ধ করতে। প্রায় ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি বগদা বর্ডার হয়ে দেশে প্রবেশ করেন। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ওড়াকান্দি স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে কর্মকাণ্ড শুরু করেন।

মুক্তিযুদ্ধে নূর মোহাম্মদ ও তার বাহিনী ৩ অক্টোবর ভাটিয়াপাড়া ওয়ালেস সেন্টারে হামলা চালিয়ে দখল করেন। এতে ১৯ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ১০ অক্টোবর শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীদের পরাস্ত করেন। ১৪ অক্টোবর শরীয়তপুরের ডামুড্যা যুদ্ধে জয়ন্তী নদীর পাড়ে ৬ ঘণ্টা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এ যুদ্ধে ৬৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন।

নূর মোহাম্মদ বলেন, ২৭ নভেম্বর টুঙ্গিপাড়া গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা ও মায়ের সঙ্গে দেখা করি। ৩০ নভেম্বর হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে কোটালিপাড়া মুক্ত করি। ৭ ডিসেম্বর বিনা যুদ্ধে গোপালগঞ্জ মুক্ত করি। পরে সিদ্ধান্ত নেন ফরিদপুর মুক্ত করার। বিজয় দিবসের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর ফরিদপুরে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

ফরিদপুর শহরের ১ নম্বর গোয়ালচামট মহল্লার বাড়িতে বসবাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি সে বাড়ির দোতলায় আনুমানিক ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট একটি সেমিপাকা কক্ষে গড়ে তুলেছেন একটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর। এ জাদুঘরে তার নিজেরসহ বহু মুক্তিযোদ্ধার দুর্লভ ছবি রয়েছে। রয়েছে ওই সময় জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকদের ছবি। এ ছাড়া, যুদ্ধকালীন স্মৃতি সম্বলিত হেলমেটসহ নানান উপকরণ।

এই জাদুঘরটির ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি শঙ্কিত। তিনি না থাকলে কে করবে এর দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণ—এই নিয়ে চিন্তা তার।

নূর মোহাম্মদ বলেন, আমার বয়স হয়েছে। শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে। এ শরীর নিয়ে আর বেশিদিন হয়তো বাঁচব না। তাই আমার সংগ্রহশালাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিজ হাতে গড়া এই জাদুঘরটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে স্থানান্তর করে যেতে চাই।

জহির হোসেন/এএমকে