ফোন করলেই বাড়িতে অক্সিজেন পৌঁছে দেন তারা
রাত ৩টা। হঠাৎই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় ফিরোজাবাদ এলাকার বাসিন্দা সাঈদা রায়হানার (৩০)। করোনা-নিউমোনিয়া নিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। জরুরি অক্সিজেন প্রয়োজন পড়ে তার। লকডাউনের গভীর রাত। চারদিক সুনসান নীরবতা। যানশূন্য রাস্তায় দ্রুত হাসপাতালে নেওয়াও কঠিন।
তখনই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) হটলাইনে (০১৭৫৮-৯০১৯০৩) ফোন দেন স্বজনরা। রিং বাজতেই ফোন তুলে দায়িত্বরত কর্মী চানতে চান অবস্থান। এসএমএস করে নাম-ঠিকানা পাঠাতে বলেন। মাঝে কেটে যায় কয়েক মিনিট সময়। এসএমএস লেখা শেষ, এবার পাঠানোর পালা। ততক্ষণে দরজায় এসে পৌঁছায় অক্সিজেনবাহী গাড়ি। সিলিন্ডার বহন করে বাসায় পৌঁছে দেন রাসিকের কর্মী শরিফুল ইসলাম। নিজহাতে নেজাল ক্যানোলা নাকে দিয়ে চালু করেন সিলিন্ডার। ধীরে ধীরে স্বস্তি পান রোগী। শঙ্কা কাটে স্বজনদের। আঁধার কেটে ফোটে আলো।
বিজ্ঞাপন
করোনা পজিটিভ হয়ে নিজ বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন ষাটোর্ধ্ব খালিদ এবাদুল্লাহ। নগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকার এই বাসিন্দার ফুসফুসে সংক্রমণ ছাড়িয়েছিল ৭০ শতাংশ। তা সত্ত্বেও হাসপাতালে যেতেই চাইছিলেন না। মধ্যরাতে অক্সিজেন সেচুরেশন নেমে আসে ৮৮তে।
তখনই রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কন্ট্রোল রুমের ০১৩২০-০৬৩৯৯৮ নম্বরে ফোন দেন স্বজনরা। সেখান থেকে যুক্ত করা হয় নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসির সঙ্গে। সংবাদ পেয়ে ১৫ মিনিটের মাথায় পুলিশ অক্সিজেন পৌঁছে যায় বাসায়।
বিজ্ঞাপন
সেই থেকে টানা ১৫ দিন নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সেবা দিচ্ছে ‘পুলিশ কোভিড অক্সিজেন ব্যাংক’। দিনে অন্তত দুটি করে সিলিন্ডার রিফিল যাচ্ছে ওই রোগীর বাসায়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে অক্সিজেন স্বল্পতায় অথবা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এমন রোগীদের সেবায় গত ১৫ জুন ‘পুলিশ কোভিড অক্সিজেন ব্যাংক’ চালু করে রাজশাহী মহানগর পুলিশ। এর দুইদিন পর ১৭ জুন জরুরি অক্সিজেন সেবা চালু করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। এক ফোনকলেই বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন রাসিকের কর্মীরা। এনিয়ে খরচা হচ্ছে না এক পয়সাও।
রাসিকের এই কার্যক্রম মনিটরিং করেন শরিফুল ইসলাম। কী রাত কী দিন ২৪ ঘণ্টায় তিনিসহ তার দলের সদস্যরা সংকটাপন্ন রোগীদের বাসায় ছোটেন অক্সিজেন কাঁধে। করোনার সংকটকালে নগর কর্তৃপক্ষের এই মানবিক উদ্যোগ এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে।
এই উদ্যোগের পেছনে আছেন রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামন লিটন। অক্সিজেন সেবা চালু করে তিনি জানিয়েছিলেন, জীবন সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়াতেই রাসিকের এই উদ্যোগ। শুধু অক্সিজেনই নয়, আক্রান্ত ব্যক্তির খাবার ও ওষুধ প্রয়োজন হলে সেটিও সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছিলেন মেয়র।
রাসিকের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও জরুরি অক্সিজেন সেবা কার্যক্রমের সমন্বয়কারী ডা. তারিকুল ইসলাম বলেন, ২০০টি সিলিন্ডার নিয়ে তারা এই বিশেষ সেবা কার্যক্রম শুরু করেন। পরে আরও ছয়টি সিলিন্ডার অনুদান হিসেবে যোগ হয়। এর মধ্যে ১০টি করে সিলিন্ডার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁ জেলার সিভিল সার্জন দফতরে দিয়েছেন মেয়র। যাতে প্রান্তিক মানুষজন এই সেবা পায়। তাছাড়া নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে জরুরি ব্যবহারের জন্য একটি করে সিলিন্ডার রাখা হয়েছে। এই ৩০টিসহ মোট ১৬৬টি সিলিন্ডারে ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন সেবা দিচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষ।
তিনি আরও বলেন, ১ জুলাই পর্যন্ত ২২৪ জনকে তারা অক্সিজেন সেবা দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৩০টি সিলিন্ডার ফেরত এসেছে। বাকিগুলো রয়ে গেছে রোগীদের বাড়িতেই। তাছাড়া ৩৫ জনকে ওষুধ এবং ৫৭ জনকে খাদ্য সহায়তাও দেওয়া হয়েছে। সংকটাপন্নদের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে খালি এবং অব্যহৃত সিলিন্ডার দ্রুত ফিরিয়ে দিতে সেবা গ্রহীতাদের প্রতি অনুরোধ জানান এই চিকিৎসক। বিনা প্রয়োজনে অক্সিজেন মজুত না রাখারও আহ্বান জানান তিনি।
নগর পুলিশ কিংবা রাসিকের মত বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিচ্ছে সন্ধানী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ইউনিট। তাদের এই মানবিক কাজের পেছনে রয়েছে রাজশাহী সমিতি, ঢাকা এবং রাজশাহীর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মেডিকেল সেন্টার।
সন্ধানীর ইউনিট সভাপতি নিশীথ কুমার মণ্ডল (০১৫২১৩০০৪৫৬) কিংবা সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিনের (০১৯৫৬২৩২৫৫২) নম্বরে ফোন দিলে তারাও পৌঁছে দিচ্ছেন সিলিন্ডার।
এ বিষয়ে নিশীথ কুমার মণ্ডল জানান, তারা ৭টি সিলিন্ডার নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। এখন তাদের সিলিন্ডার সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে তারা সেবা দিয়েছেন সাতজনকে। পর্যায়ক্রমে তাদের সিলিন্ডারও বাড়বে।
অন্যদিকে আরএমপির মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, ১০০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও তাদের এখন ১৩৬টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এ পর্যন্ত পুলিশের এই বিশেষ সেবা নিয়েছেন ১৬০ জনের বেশি মানুষ, যারা সবাই সাধারণ নাগরিক। সিলিন্ডার রিফিল করে ৪ শতাশিক বার সেবা দিয়েছে পুলিশ। এছাড়া যাদের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন, তাদের সেই সহায়তাও দেয়া হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে রাজশাহীতে অক্সিজেন চাহিদা বাড়লেও আপাতত সংকট নেই বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের শুরুতে হাসপাতালে অক্সিজেন লাইন ছিল ৬৫টি। সেই সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০৫ এ উন্নীত করা হয়েছে। প্রত্যেক শয্যায় দেয়া হয়েছে অক্সিজেন।
আগে দিনে ৬০০ লিটার অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। এখন সেটি বেড়ে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার লিটারে দাঁড়িয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ১০ হাজার লিটার ট্যাংক থেকে। এছাড়াও মজুত রাখা হয়েছে আরও ১৪ হাজার লিটার।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনা রোগীদের টিকিৎসা একেবারেই সাধারণ। কিন্তু ফুসফুসে সংক্রমণ থাকায় একপর্যায়ে জরুরি হয়ে পড়ে অক্সিজেন। সেটি না পেলে রোগী মারা যান। তখন যত দ্রুত অক্সিজেন দেওয়া যায় সেটি বড় বিষয়। তবে যাদের ফুসফুসে সংক্রমণ নেই তাদের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন নাও পড়তে পারে। কিন্তু অক্সিজেন সেচুরেশন লেভেল ৯২ নামলেই হাসপাতালে নিতে হবে।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জনের দফতর জানিয়েছে, রাজশাহীতে এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৮৪৫ জনের। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৪৫৬ জন রাজশাহী নগরীর বাসিন্দা। গত ২৪ ঘণ্টায় নগরীতে ২১৩ জনের শরীরে করোনা ধরা পড়েছে। জেলার ৯ উপজেলায় এই সংখ্যা মাত্র ২৮।
এ পর্যন্ত জেলায় করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৪ জন। এর মধ্যে ৯২ জনই রাজশাহী নগরীর বাসিন্দা। বাকি ৭২ জন রাজশাহীর ৯ উপজেলার বাসিন্দা। এ পর্যন্ত জেলায় ৯ হাজার ৮৮৫ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ হাজার ১২৩ জনের বাড়ি নগরীতে।
অন্যদিকে গত দুই দিনে রামেক হাসপতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে মারা গেছেন ৩৯ জন। এর আগে জুন মাসে ৪০৫ জন মারা গেছেন এই ইউনিটে। গত ১৪ মাসে হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গে মারা গেছেন সবমিলিয়ে এক হাজার ৭৮ জন।
আরএআর