এক সপ্তাহ লকডাউনে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও শ্রমজীবী লোকজন

‘দুই দিন ধরে না খেয়ে আছি। পরিবারের লোকজনও না খেয়ে আছে। পেট তো মানে না। তাই গাড়ি নিয়ে বের হইছি।’

সুনামগঞ্জ শহরের অলিগলিতে পড়ে থাকা বোতল, প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন তিনি। সরকারের এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউনে অন্য আর দশজনের মতো তিনিও বেকায়দায় পড়েছেন। তিন দিন ধরে ভ্যানগাড়িটি নিয়েও বের হতে পারেননি। তাই কোনো আয়রোজগার হয়নি।

তাই কাছে গিয়ে জানতে চাইলে ওপরের তিক্ত কথাগুলো বললেন ভাঙারি টোকাই জালাল মিয়া।

জালাল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪ ভাই ২ বোনের সংসার তার। বয়সের ভারে বাবা অনেক আগেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তার অন্য ভাইয়েরা রিকশা চালান। এ জন্য অভাব-অনটনের সংসার নামকাওয়াস্তে চলত আগেই। কিন্তু করোনা এসে টানাটানির সংসারে দুর্দশা নামিয়ে এনেছে। জীবন চালানোই যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউনের প্রথম দিন টেনেটুনে চলা গেলেও গত দুই দিন একদম চুলায় হাঁড়ি বসেনি তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের দেওয়া এক সপ্তাহ লকডাউনে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও শ্রমজীবী লোকজন। অনেকে হারিয়েছেন কাজ। অনেক দিনমজুরের মিলছে না কোনো কাজ। রাস্তায় রাস্তায় কাজের সন্ধানে ঘুরে দিন শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার বাসিন্দা কালাগাজী। ১২ বছর ধরে সুনামগঞ্জে ফেরি করেন। প্রতিদিন মাঝবয়সী কালাগাজীর কাঁধে ওঠে তার বয়সের চেয়েও দ্বিগুণ নতুন নতুন হাঁড়ি পাতিলের ভার। পা টিপে টিপে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব জিনিসপত্র বিক্রি করতেন তিনি। ভালোই আয় হতো তার। শহরে ১ হাজার ৫০০ টাকা বাসা ভাড়া ও থাকা-খাওয়ার খরচ মিটিয়ে পরিবারকেও টাকা পাঠাতেন। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে তিনি বাসা থেকে বের হতে পারেননি। এতে খাবারদাবার বন্ধ। 

কালাগাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাঁড়ি-পাতিল প্রতিদিন মহাজনের কাছ থেকে নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতাম। দিন শেষে যা আয় হতো, মহাজনকে দিয়ে আমার ভালোই থাকত। এখন কঠোর লকডাউনের ফলে এক সপ্তাহ বের হতে পারিনি। উল্টো মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করে চলছি। এ কয়দিনে মহাজনের কাছে ১ হাজার ৫০০ টাকা ঋণী হয়েছি। তাই লকডাউন অমান্য করে আজ  হাঁড়ি পাতিলের ভার নিয়ে বের হয়েছি। তবে এখনো এক টাকাও বেঁচতে পারিনি।

শুধু কালাগাজী নন, মো. আব্দুল সালাম, গোলচান্দ, জয়নাল আবেদীন, হাছননগরের বাসিন্দা হেলেনারও একই অবস্থা। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তারাও জানান দৈনন্দিন কষ্টের অবর্ণনীয় কথা।

রিকশা-সাইকেলের মেকার মো. আব্দুল সালাম পৌর শহরের মল্লিকপুরের বাসিন্দা। তিনি বলেন, লকডাউন দিয়েছেন, ভালো। ভাইরাসের প্রকৌপ কমবে, সেটা আমরাও চাই। তবে আমরা খাব কী? কেউ তো এখনো কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করছেন না। আমরা কীভাবে চলমু, কীভাবে খাইমু, এ নিয়ে কেউ কিছু বলে না। এখন ধারদেনা করে কোনোবায় কোনোবায় চলতাছি। এই লকডাউনে আমরারে একেবারে জানে মারিলিছে।

রিকশাচালক গোলচান্দ বলেন, আমার ৫ ছেলে মেয়ে। কেউ এখনো কাজ করবার উপযুক্ত হয়নি। তাই আমি একাই রিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। রিকশার চাকা ঘুরলে পেট চলে। লকডাউনের আগে যে রুজি করছি, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলছে। আর এখন সারা দিনে ২০০ টাকাই রুজি করতে পারি না। বউ-বাচ্চা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন যাইতেছে।

রিকশা চালক জয়নাল আবেদীন বললেন, লকডাউনে চলতে পারছি না। বাচ্চাদের খাওয়াইতে পারছি না। আমরার তো এখন জীবন বাঁচানো ধমারধম (কষ্ট)! যাদের সরকারি চাকরি আছে, তাদের তো সমস্যা নেই। বেতন ঠিকমতো পায়। আমরা কষ্ট করে মেহনত করে খাই। শান্তি যা ছিল চলে গেছে, এখন লকডাউনে অশান্তির দিন আসছে।

হাছননগরের বাসিন্দা হেলেনা বললেন, তিনি মানুষের বাসায় কাজ করতেন। করোনা ভাইরাসের কারণে বাসায় কাজ হারিয়েছেন তিনি। এখন সারাদিন মানুষের বাসায় বাসায় কাজের জন্য ঘুরেন। দিন শেষে কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হয় থাকে।

সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহসভাপতি অ্যাডভোকেট খলিল রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার এর আগে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এবার এখনো সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার কোনো কার্যক্রম আমরা দেখছি না। যাদের লকডাউনের আওতায় বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান নেই, তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সচ্ছল মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।

লকডাউনে বিপাকে পড়া মানুষদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা রয়েছে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বললেন, দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করব। আগামীকাল সাচনা বাজারে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হবে। আমি সেখানে যাব। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব জায়গায় বিপাকে পড়া মানুষদের মানবিক ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে।

সাইদুর রহমান আসাদ/এনএ