চাহিদার অজুহাতে দামও বাড়িয়েছেন ফার্মেসির মালিকরা

তৃতীয় দফায় করোনার বিস্তার ভয়ংকর রূপ নিয়েছে দেশে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সঙ্গে লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর সারি। অদৃশ্য এই ভাইরাসের উপসর্গ এখন ঘরে ঘরে। দুই সপ্তাহ ধরে রংপুর অঞ্চলে হঠাৎ বাড়তে শুরু হয়েছে জ্বর-সর্দি, কাশি-হাঁচি ও ব্যথায় আক্রান্ত রোগী। বেশির ভাগ আক্রান্তের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ভারতীয় ভ্যারিয়ান্টের উপসর্গ।

এ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ স্বাস্থ্য বিভাগের।

চিকিৎসকেরা বলছেন, শুধু করোনাভাইরাস নয়, ঋতু পরিবর্তনেরও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ কারণে সবখানেই এখন জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে বলে জানান তারা।

এদিকে প্রভাব পড়েছে ওষুধপাড়ায়। চাহিদার সঙ্গে বেড়েছে প্রয়োজনীয় প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের দাম। রংপুর অঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধের আওতামুক্ত ওষুধ সরবরাহকারী কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান ও ফার্মেসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের দাবি, লকডাউনে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দেখা মিলছে না। তবে এটি কৃত্রিম সংকট নয়, বরং কোম্পানি থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় সাময়িক এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরসহ বিভাগের প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলার ফার্মেসিগুলোয় সহজে মিলছে না জ্বর-সর্দি, কাশি-হাঁচির ওষুধ। চাহিদা বাড়ায় অনেক ফার্মেসিতে নাপা, নাপা এক্সটেন, জি-ম্যাক্স, এইচ, এইচ প্লাসসহ প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেটের সংকট রয়েছে। তবে চাহিদার অজুহাতে দামও বাড়িয়েছেন ফার্মেসির মালিকরা। বিশেষ করে পাড়া-মহল্লার ফার্মেসিগুলোতে বেশি দামে প্যারাসিটামল বিক্রি হচ্ছে।

অনেক জায়গায় ফার্মেসিতে ওষুধ না পেয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। আবার কোথাও কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ মিলছে ফার্মেসি-মালিকদের বিরুদ্ধে।

ক্রেতাদের অভিযোগ, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় লাভের আশায় ফার্মেসি-মালিকেরা এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেছেন।

রংপুর নগরীর কৈশাল রঞ্জন স্কুল মোড়ের নিউ ফার্মেসিয়ার স্বত্বাধিকারী হামিদুল ইসলাম হামিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে জ্বর, সর্দি, কাশির প্রকোপ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় কোম্পানিগুলো আমাদের ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। বিশেষ করে নাপা ট্যাবলেট, নাপা সিরাপ, এইচ ট্যাবলেট ও এইচ সিরাপের চাহিদা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে প্রতি পাতা নাপা ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে প্রতি পাতা আট টাকা ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের দাম বাড়েনি। নাপা এক্সটেন প্রতি পাতা ১৫ টাকা, জি-ম্যাক্স প্রতি পাতা ১১০, এইচ প্লাস ২৪ টাকা পাতা বিক্রি হচ্ছে।

শাপলা চত্বরের থ্রি-স্টার ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী মাসুদ বলেন, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেটের চাহিদা এখন বেশি। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানিগুলো থেকে প্যারাসিটামল গ্রুপের ট্যাবলেট সরবরাহ কমিয়েছে। আবার অনেক কোম্পানির প্রতিনিধি আসছেন না। এ কারণে চাহিদার তুলনায় সংকট মনে হচ্ছে। তবে ওষুধের দাম বাড়েনি।

দিনাজপুরের হাকিমপুরেও উপজেলায়ও একই চিত্র। সেখানেও প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। জ্বরের প্রতিষেধক বেক্সিমকো গ্রুপের নাপা সিরাপ, নাপা ট্যাবলেট, নাপা এক্সটেন্ড, নাপা এক্সট্রা, নাপা ওয়ান এবং স্কয়ার গ্রুপের এইচ, এইচ প্লাস, এইচ ৫০০ সহ অন্যান্য কোম্পানির জ্বরের ওষুধ সহসাই মিলছে না।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে একটি ফার্মেসির সামনে কথা হয় নাসির নামের একজনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েক দিন ধরে আমার মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত। ওষুধের জন্য দোকানে এসেছিলাম, কিন্তু ওষুধ নেই। এখন অন্য কোথাও খোঁজ করতে হবে।

এনতাজ নামের একজন অভিযোগ করে বলেন, যদিও দু-একটি ফার্মেসিতে জ্বর-সর্দির ওষুধ মিলছে, কিন্তু চাহিদা থাকায় তারা বেশি দামে বিক্রি করছে। সত্যিকার অর্থে কোম্পানিগুলোতে ওষুধের সংকট রয়েছে কি না, তা প্রশাসনকে খতিয়ে দেখা উচিত।

বেক্সিমকো গ্রুপের হাকিমপুর উপজেলার রিপ্রেজেন্টেটিভ আলেমন হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, বর্তমানে সবার ঘরে ঘরে জ্বর হওয়ায় উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বাড়ছে। যে কারণে বাজারে সরবরাহ কমেছে। এই মাসের মধ্যে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।

হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার ডা. গাদ্দাফী সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই সময়ে জ্বরের প্রকোপটা একটু বেশি। বাজারে ওষুধের সরবরাহ আছে কি নেই, তা আমি বলতে পারব না। তবে হাসপাতাল কমপ্লেক্সে জ্বরের সব ধরনের ওষুধ রয়েছে। এখন আক্রান্তের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে থাকা বেশি প্রয়োজন, সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ তো অবশ্যই নিতে হবে।

ওষুধ-সংকট সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান রংপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান মৃধা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট উদ্বেগজনক। আমরা বিভিন্ন সময়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তা-ই করা হবে।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক এ দুর্যোগের সময় কেউ যদি ওষুধের সংকট তৈরি করে বা বেশি দাম নেয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ পেলে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. আবু মো. জাকিরুল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলার বিকল্প নেই। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ