সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো আর নেই
খালেদুর রহমান টিটো (ফাইল ছবি)
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও যশোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খালেদুর রহমান টিটো আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। রোববার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
১৯৮৬ সালে খালেদুর রহমান টিটো জাতীয় পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হন এবং ১৯৯০ সালের মে মাসে শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ২০০৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বিজ্ঞাপন
খালেদুর রহমান টিটোর বড় ছেলে মাশুক হাসান জয় জানান, কিছুদিন ধরে তার বাবা অসুস্থ ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) তাকে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার দুপুর ১টা ১৯ মিনিটে তিনি মারা যান।
মাশুক হাসান জয় আরও জানান, হাসপাতাল থেকে মরদেহ শহরের ভোলাট্যাংক রোডস্থ বাসভবনে নেয়া হবে। এরপর জানাজা, দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিজ্ঞাপন
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বেশ কিছুদিন ধরেই সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো অসুস্থ ছিলেন। গত ১৯ নভেম্বর তিনি নিজ বাসভবনে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরদিন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তার ফুসফুসে পানি জমেছে ধরা পড়ে। সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়ার পর তার অবস্থার উন্নতি হয়। পরে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর বাড়িতেই তার চিকিৎসা চলছিল।
কয়েকদিন আগে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার সেখান থেকে তাকে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে আইসিইউতে ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি তিন ছেলেসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও কর্মী, সমর্থক রেখে গেছেন।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ খালেদুর রহমান টিটো ১৯৪৫ সালের ১ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট হবিবুর রহমান এবং মা মরহুম করিমা খাতুন। সাত ভাইবোনের মধ্যে টিটো দ্বিতীয়। বড় ভাই মাসুকুর রহমান তোজো যশোরের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডাবল অনার্স নিয়ে ফিজিক্সে মাস্টার্স পাস করেছিলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
খালেদুর রহমান টিটো রাজনৈতিক পরিমন্ডলের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৬৩ সালে যশোর এম এম কলেজ সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নে সম্পৃক্ততার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করেন।
১৯৬৭ সালে কলেজের লেখাপড়া শেষ করে তিনি শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে শ্রমিক রাজনীতি থেকে বের হয়ে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন। শ্রমিক রাজনীতিতে থাকাকালীন তিনি মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি ঐ সময় শ্রমিকদের সংগঠিত করতে সমর্থ হন।
খালেদুর রহমান টিটে যশোরে প্রথম রিকসা ইউনিয়ন তৈরি করে তাদের সংগঠিত করেন এবং ব্যক্তিগত সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তিনি কৃষক আন্দোলন জোরদার করতে কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও কালীগঞ্জ এলাকায় ভ্রমণ করেন।
১৯৭০ সালের শেষের দিকে তার সঙ্গে দলের রাজনৈতিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। শ্রেণী শত্রু উৎপাটনের পদ্ধতিকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। ফলে এক সময় দল থেকে বের হয়ে আসেন। এ সময় তিনি পুলিশি অভিযানের কারণে কুষ্টিয়াতে চলে যান। ঐ বছরের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আবার ভারতে চলে যান। বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে সেখানে তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি আবার পূর্ব পাকিস্তানেও ঢুকতে পারতেন না। এর কারণ হিসেবে ঐ সময় পাক আর্মি তার মাথার দাম ধার্য করেছিল ১০ হাজার টাকা।
১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ভাসানী-ন্যাপ) যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে ন্যাপের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে ন্যাপের যশোর অঞ্চলের সভাপতি প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আলমগীর সিদ্দিকী মারা গেলে তিনি ন্যাপের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নির্বাচনের সময় ন্যাপের পক্ষ থেকে তাকে সমর্থন করেন। নির্বাচনের পর বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলে তিনি ন্যাপের সঙ্গেই থেকে যান। ১৯৮১ সালে ‘গণতান্ত্রিক পার্টি’ গঠিত হলে তিনি এই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দেন।
১৯৮৪ সালে পৌরসভার নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে জাতীয় পার্টি গঠিত হওয়ার পর ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি পক্ষ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সরকার পতনের ফলে ১৯৯১ সালে তাকে জেলে যেতে হয়। এ সময় তিনি জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ সালে দলকে নতুনভাবে সাজানো হলে তিনি কারাগারে থাকাকালীন কৃষি বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
১৯৯১ এর শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব হন এবং ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি মনোননয়ন না পাওয়ায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। পরে তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন।
খালেদুর রহমান টিটোর বাল্যশিক্ষা শুরু হয় যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬০ সালে এখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকার কায়েদে আজম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৭ সালে কারাগারে অবস্থানকালে যশোর এম এম কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন।
১৯৭২ সালের ১৮ মে যশোর শহরের চুরিপট্টি এলাকার মেয়ে রওশন আরা বেগম বিন্তকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তিনি তিন পুত্র সন্তানের জনক। ২০০৭ সালে স্ত্রী মারা যান। ছোটবেলায় খালেদুর রহমান একজন ভাল খেলোয়াড় ও একজন ভাল তবলাবাদক ছিলেন। তার হাত দিয়ে যশোরের অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
এসপি