একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সায়েরা বেগমের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা একাধিক অপারেশন চালিয়ে সফলতা পেয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশে সায়েরাকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সেই স্বীকৃতি কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে তার ভাতা। আর তাই ৬৯ বছর বয়সী সায়েরাকে জীবন সায়াহ্নে এসেও লড়তে হচ্ছে স্বীকৃতির জন্য। 

সায়েরা বেগম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের সেজামুড়া গ্রামের বাসিন্দা। দুই বছর আগে স্বামীকে হারান তিনি। এখন এক মেয়ে আর দুই নাতনিকে নিয়ে চরম অর্থকষ্টে দিন কাটছে তার। মুক্তিযুদ্ধের সময় সায়েরার বাবা আব্দুল আজিজ পাক হানাদার বাহিনীর বাংকার তৈরি করতেন। তখনকার ১৬-১৭ বছরের কিশোরী সায়েরা তার বাবার মাধ্যমে পাক বাহিনীর ক্যাম্পের সকল খবরাখবর সংগ্রহ করে পৌঁছে দিতেন মুক্তিবাহিনীর কাছে।

হানাদার বাহিনীর সব খবর পাওয়ার জন্য এক ক্যাম্প কমান্ডারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন সায়েরা। এভাবে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য এক সময় জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়েন তিনি। সেজন্য এলাকাও ছাড়তে হয় তাকে। কিন্তু তবুও প্রিয় মাতৃভূমির জন্য কাজ করে গেছেন সায়েরা। তার খবরের ভিত্তিতে চালানো একাধিক অপারেশনে সফলতা পায় মুক্তিবাহিনী। বিশেষ করে পাহাড়পুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুরে হওয়া যুদ্ধে সায়েরার কারণেই পাক বাহিনীকে পরাস্থ করা গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

গত ৭-৮ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করছেন সায়েরা। তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তালিকা ও গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উপজেলা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সাল থেকে ভাতা সুবিধা ভোগীর তালিকায় নাম উঠে সায়েরার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে তার ভাতা বন্ধ রয়েছে।

দেশের স্বার্থে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাক হানাদার বাহিনীর খবর জোগাড়ের দিনগুলোর স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে সায়েরার চোখে। সেই স্মৃতি মনে করে এখনো কেঁদে ওঠেন তিনি।

সায়েরা বেগম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা-ভাই ও আত্মীয়-স্বজনকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে দিয়ে বাংকার তৈরির কাজ করাত। তখন আমি বাবার কাছ থেকে পাকবাহিনীর ক্যাম্পের খবরাখবর নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে দিতাম। আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিতেন। এভাবে তিন-চার মাস তথ্য দেওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর লোকজন আমার পরিবারের সবাইকে ভারতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সায়ীদ স্যারের (৩নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ) কাছে নিয়ে যায়। 

তিনি বলেন, সায়ীদ স্যার পাক হানাদার ক্যাম্প সম্পর্কে জানতে চাইলে বলি যে, ক্যাম্পে ৬০/৭০ জন মানুষ হবে। ক্যাম্পে কী কী অস্ত্র আছে এবং আমি দেখেছি কিনা- জানতে চাইলে বলি যে, আড়াল থেকে দেখেছি। কিন্তু অস্ত্রের নাম জানতাম না। তখন আমি বলি অস্ত্রগুলো দেখতে তিন ঠ্যাঙ ওয়ালা আর চোঙ্গার মতো। আমার কথায় সায়ীদ স্যার অস্ত্রগুলো কী হতে পারে সেটি ধারণা করে নেন। এরপর যেভাবে বলেছি, সেভাবেই অপারেশন চালিয়ে মুক্তিবাহিনী জয়ী হয়েছে। 

সায়েরা বলেন, তখন যা করেছি- দেশকে ভালোবেসে করেছি। যতটুকু পেরেছি দেশের জন্য করেছি। এখন যদি সরকার আমাকে মেনে নেয় তো নেবে, না হলে আমার কিছু করার নেই। আমার তো বয়স হয়েছে। আমি দেশের জন্য কাজ করেতে পেরেছি এটাই আমার সৌভাগ্য। আমার স্বামী-ছেলে সন্তান নাই। ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে চলতে কষ্ট হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর তো দেখা উচিত আমি কী হালে জীবন কাটাচ্ছি। সরকার যদি আমাকে কিছু নাও দেয় তাতেও আমার আপত্তি নেই। 

মুক্তিযুদ্ধে সায়েরা বেগমের অবদান নিয়ে যুদ্ধকালীন ৩নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ (বীর প্রতীক) তার দেওয়া প্রত্যায়নে বলেন, ‘নিজের জীবন বাজি রেখে সায়েরা স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রেখেছেন। মুকুন্দপুর শত্রু বাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তিনি আমার অধীনস্থ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেন। ক্যাম্পে অবস্থানরত শত্রুর সংখ্যা, প্রতিরক্ষা অবস্থান, অস্ত্রশস্ত্র, ক্যাম্প অধিনায়কসহ সৈনিকের মনোবল সম্পর্কে তার প্রদত্ত সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ নভেম্বর মুকুন্দপুরে শত্রুদের ওপর আক্রমণ করা হয়। এতে বহু পাকসেনা আহত হয় এবং ২৯ জনকে বন্দি করা হয়। মুকন্দপুর শত্রুমুক্ত হয়।’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সায়েরার অবদান এভাবে চিত্রিত হলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে এখনও লড়াই করতে হচ্ছে তাকে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সায়েরার নাম তালিকা ও গেজেটভুক্ত করতে তার আবেদন নিয়ে নিজের সুপারিশ ও প্রত্যায়নসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। এরপর একটি আধা সরকারিপত্রও দেন তিনি। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. ফুল মিয়া বলেন, সায়েরার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মুকুন্দপুরে পাক বাহিনীর সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করি। কোথায় পাক বাহিনীর ক্যাম্প আছে, কী অবস্থায় আছে এবং ক্যাম্পে কতজন লোক আছে- সেই তথ্যগুলো সেক্টর কমান্ডারকে দেন সায়েরা। তার তথ্যেই আমরা মুকুন্দপুরের যুদ্ধটা সঠিকভাবে করতে পেরেছিলাম। সায়েরার অবদান ভুলার নয়। তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। 

এ ব্যাপারে বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে. এম. ইয়াছির আরাফত বলেন, সায়েরা বেগমের নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উপজেলা কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পরই তার ভাতা চালু হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকেই আবার তার ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদি মন্ত্রণালয় আবার লিখিত নির্দেশ দেয়, তাহলে পুনরায় সায়েরার ভাতা চালু করা হবে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, সায়েরা পাকিস্তানি ক্যাম্প কমান্ডারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য। এটিও যদি কেউ বিবেচনায় না আনে, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কতবার সায়েরার জন্য লিখেছি, তার কোনো হিসেব নেই। যতবারই সায়েরার কথা বলি, মন্ত্রী বলেন আমি ফাইলটা দেখে নেই। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সায়েরার বয়স হয়েছে, যে কোনো সময় তিনি মারা যেতে পারেন। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক ও দুঃখজনক হবে। আমি মনে করি পরিপূর্ণভাবে এর তদন্ত হওয়া উচিত। 

আরএআর