‘করোনা নিঃস্ব করে দিল’
‘বাবা মারা গেছেন ১২ বছর আগে। সেই থেকে কৃষিকাজ করে ছোট ভাই আরিফুলকে দেখভাল করি। লেখাপড়া শিখিয়ে মাস্টার্স করিয়েছি। চাকরির আবেদন করবে। আর এরমধ্যেই করোনার প্রভাব শুরু হয়ে যায় দেশে। তাই আর আবেদন করা হয়নি। গত ১৭ জুন থেকে সর্দি কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন আরিফুল। ২৪ জুন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অভাবের মধ্যেই চিকিৎসার পেছনে ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেল। নিঃস্ব হয়ে গেলাম। করোনা আমাকে নিঃস্ব করে দিল।’
এভাবেই ঢাকা পোস্টের কাছে নিজের অসহায় পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন আরিফুল ইসলামের বড় ভাই রবিউল ইসলাম (৩৫)। তিনি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়নের কুন্দুড়িয়া গ্রামের মৃত. আবুল হোসেন মোড়লের ছেলে। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও মাকে নিয়ে সংসার তার। ছোট ভাই আরিফুল ইসলামও (২৮) রয়েছে এ সংসারে। বড় দুই বোন বিবাহিত। তারা রয়েছেন স্বামীর সংসারে।
বিজ্ঞাপন
রবিউল ইসলাম বলেন, ‘অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ টাকা রোজগার হয়। সবমিলিয়ে মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা আয় হয়। সেই টাকাতেই সংসার চালাতে হয়। ছোট ভাই আরিফুল করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমার গচ্ছিত কোনো টাকা নেই। পরিচিত ও আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। বিলের মধ্যে তিন বিঘা জমি আছে। যেখানে ধান হয় না। ভেবেছি সেই জমিটা ইজারা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করব।’
তিনি বলেন, ‘১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালেই রয়েছি। বাড়িতে স্বজনরা বাজার দিচ্ছেন। তাতেই খেয়ে না খেয়ে সংসার চলছে। সরকারি কোনো সহায়তাও আমার পরিবার পায়নি। হাসপাতাল থেকে কিছু ওষুধ ফ্রি দিচ্ছে, এ সহায়তাটুকুই পেয়েছি।’
বিজ্ঞাপন
নিম্ন আয়ের পরিবারে করোনা হানা দিলে অনেকের গল্পই এমন হয়। করোনার ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ যোগাতে পরিবারের কর্তাদের হিমশিম খেতে হয়। সাতক্ষীরার তালা সদরের শিবপুর গ্রামের মৃত. নছিমউদ্দীন সরদারের ছেলে আব্দুর রশিদ সরদার। কৃষিকাজ করে পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৯ জুন থেকে চিকিৎসাধীন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার ছেলে আব্দুর রশিদ সরদারের ছেলে মুকুর সরদার বলেন, ‘আব্বাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। শারীরিকভাবে এখন অনেকটা সুস্থ। ধারদেনা করে আব্বার চিকিৎসা করাচ্ছি।’
করোনা পরিস্থিতিতে সাতক্ষীরায় দারিদ্র্য সম্পর্কে জেলা পরিসংখ্যান অফিসের উপ-পরিচালক মো. বছির উদ্দীন বলেন, ‘জেলার জনসংখ্যা ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯০। এর মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ২৫ দশমিক ১ ভাগ মানুষ। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কোনো পরিসংখ্যান নেই। করোনাকালে মানুষের আয় অনেক কমে গেছে। কাজ হারিয়ে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রম বাজারও কমে গেছে। দিনমজুর শ্রেণির মানুষেরও আয় কমেছে। যদিও এ পর্যন্ত কোনো সার্ভে (জরিপ) করা হয়নি, তবে বলা যায়, জেলায় দরিদ্রের সংখ্যা আরও বেড়েছে।’
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের প্রধান ডা. মানস কুমার মন্ডল বলেন, ‘করোনার রোগী পাঁচ-ছয় দিন ভর্তি থাকলে ১৫ হাজার টাকার মতো ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। সরকারিভাবে কিছু ওষুধের সরবরাহ রয়েছে। সেগুলো ফ্রিতে দেওয়া হয়। করোনা প্রতিরোধে ছয়টি ইনজেকশন দেওয়া হয়। একেকটির মূল্য ১৪-১৫শ টাকা। তাছাড়া আরেকটি দামি ওষুধ দেওয়া হয়। সেটির মূল্য ১১-১২ হাজার টাকা। তবে খুব জরুরি না হলে সেটি দেওয়া হয় না। যে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন তাদের খরচ লাগে আরও বেশি। সেখানে সব ওষুধপত্রসহ অক্সিজেনও কিনতে হয়।’
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন সাফায়াত বলেন, ‘বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছে জনজীবন। করোনা আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। লকডাউন দিয়েও মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। নানা কারণে অজুহাতে বের হচ্ছে। অনেক সময় নিম্ন আয়ের মানুষ জীবিকার তাগিদে বের হতে বাধ্য হয়। আবার আক্রান্ত হলেও চিকিৎসায় সর্বস্ব খরচ হয়ে যাচ্ছে। ’
তিনি বলেন, ‘সরকারি যেসব ওষুধ রয়েছে, সেগুলো বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে বাইরে থেকেও কিছু ওষুধ কিনতে হয় রোগীকে। নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য এটি খুব কষ্টের। তবুও নিরুপায় হয়ে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। গরীব মানুষ আরও আরও গরীব হচ্ছে। সে কারণে আহ্বান জানাই, সবাইকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে এলেও অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে।’
আরএইচ