বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ৮ নং উদয়কাঠী ইউনিয়নের মুনশী বাড়ির জন্য বরাদ্দের আয়রন ব্রিজ নির্মাণ চার বছরেও শেষ হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ করে বাড়ির প্রবীণ সদস্য মো. আবু হানিফ ব্রিজটি পাস করিয়ে নিলেও জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। অথচ বরাদ্দের টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। 

অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান বরিশাল জেলা পরিষদ থেকে দাবি করা হয়েছে- কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি। শুধু ব্রিজটি খুঁজে পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। ব্রিজের স্থানে একটি ভিত্তিপ্রস্তর ছাড়া আর কিছুই করেনি জেলা পরিষদ। উপায় না দেখে ওই বাড়ির লোকজন সুপারি গাছ দিয়ে সাঁকো বানিয়ে চলাচল করছেন। ফলে দুর্ভোগ আর দুর্ঘটনা ভাগ্যের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ গৃহস্থের নিবাস মুনশী বাড়িতে। 

জানা গেছে, দিন তিনেক আগে এই বাড়ির এক গৃহবধূ সন্তানসহ পড়ে গেছেন খালে। একদিন আগে সাত বছরের একটি শিশু সাঁকো পার হতে গিয়ে খালে পড়েছে। এমন দুর্ঘটনা নিত্যদিনের। টাকা কে তুলে নিয়েছে আর কেন হয়নি ব্রিজ সেটি জানতে চান না বাসিন্দারা। তাদের দাবি, জীবনের নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দের টাকায় আয়রন ব্রিজটি নির্মাণ করা হোক।

এদিকে জেলা পরিষদ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, লকডাউন শেষ হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ডেকে প্রকল্প অনুসারে কাজ কেন করা হয়নি তা খতিয়ে দেখা হবে।

জানা গেছে, উপজেলার ৮ নং উদয়কাঠী ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের পূর্ব উদয়কাঠী গ্রামের বাসিন্দা আবু হানিফ দীর্ঘদিন চেষ্টার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে মূল সড়কের সঙ্গে মুনশী বাড়ির চলাচলের জন্য একটি আয়রন ব্রিজ পাস করান ২০১৭-১০১৮ অর্থবছরে।

তার ছেলে নুরুল আমিন মুনশী বলেন, আমরা জন্ম থেকেই সাঁকো দিয়ে চলাচল করতাম। বাড়ির সামনে যে খালটি রয়েছে সেটির বিশেষ কোনো নাম না থাকলেও খালটি অনেক বড়। আব্বা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন, বাড়ির সামনে একটি ব্রিজ নির্মাণ করার। তিনি জেলা পরিষদ সদস্য মাওলাদ হোসেন সানার মাধ্যমে একটি আয়রন ব্রিজের পাস করান। দুর্ভাগ্য আব্বা ২০১৬ সালে মারা যান। তিনি ব্রিজ দেখে যেতে পারেননি। সেই ব্রিজ আজও হয়নি। শুনেছি বরাদ্দের টাকা এসেছে। ভিত্তিপ্রস্তর দেখছি, কিন্তু ব্রিজ আর হয়নি।

মুনশী বাড়ির গৃহবধূ মোসা. তাজেনূর বেগম বলেন, ব্রিজ করতে এক লাখ টাকা এসেছে শুনেছি। এরপর কিছুদিন আমি শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম না, বাবার বাড়ি শরণখোলা বেড়াতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি চারটি লোহার বিম বসানো। এ ছাড়া বাকি যা দেখছেন তা সব আমাদের এখানে আগেই ছিল। আর ভিত্তিপ্রস্তরটুকু অল্প কয়েকদিন আগে লাগানো হয়েছে। কোনো কাজ করেনি ঠিকাদার।

তাজেনূর আরও বলেন, এত বড় খালে এক লাখ টাকায় আয়রন ব্রিজ বানানো যায় না। যারা আয়রন ব্রিজ বানাতে এসেছিলেন তারা যদি কাঠের পুল বানিয়ে যেতেন তাহলেও একটা ব্যবস্থা হতো। কিন্তু এখন যা করেছেন তা না করলেও চলত।

আব্দুস সালাম মুনশী বলেন, ব্রিজটি আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ছেলে-মেয়রা স্কুলে যেতে পারে না। বাড়ির লোকজন চলাচল করতে পারে না। সরকার থেকে যে এক লাখ টাকা এসেছে সেই টাকা কোথায় গেল তাও বলতে পারছি না।

নাছিমা বেগম নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, জন্মের পর থেকে কখনো আমাদের মুনশী বাড়ির সামনে পুল দেখিনি। আজীবন সাঁকো পার হয়েই চলাচল করছি। কয়েকবছর আগে শুনছি, সরকার থেকে পুল বানানোর জন্য টাকা আসছে। কিন্তু পুল আর কেউ নির্মাণ করেনি। এভাবেই সাঁকো রয়ে গেছে। তিনি বলেন, ব্রিজতো আমরা গুজে রাখি নাই, আবার গায়েবও করে রাখি নাই। যদি সরকার ব্রিজ বানাত তাহলে এখানেই থাকত।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় বরিশাল জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মানিকহার রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০১৯ সালে তিনি জেলা পরিষদে যোগদান করেন। ফলে পূর্ব উদয়কাঠী মুনশী বাড়ির আয়রন ব্রিজ নিয়ে কিছু বলতে পারছেন না। সম্প্রতি বরিশাল থেকে তিনিও বদলি হয়ে গেছেন। তাই কোনো মন্তব্য করতে চাননি। 

কথা হয় জেলা পরিষদের তৎকালীন প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। তিনি জানান, চার বছর আগের কাজ পুরোপুরি মনে নেই। তবে বরাদ্দের অনুকূলে ঠিকাদার সম্পূর্ণ কাজ করেই বিল তুলেছেন বলে দাবি এই কর্মকর্তার।

গোলাম মোস্তফা বলেন, মুনশী বাড়ির সামনের খালটি অনেক বড়। এত বড় খালে এক লাখ টাকায় আয়রন ব্রিজ করা সম্ভব না। তারপরও যে বরাদ্দ হয়েছে তাতে ঠিকাদার যতটুকু পেরেছেন করেছেন। 

তিনি আরও বলেন, এখন চারটি লোহার বিম কিনতেই এক লাখ টাকার বেশি লাগে। ওই খালে আয়রন ব্রিজ করতে কমপক্ষে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দের দরকার।

ঠিকাদারের বিল দেওয়ার আগে প্রকল্পের আয়রন ব্রিজ জেলা পরিষদের কেউ পরিদর্শন করেছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আয়রন ব্রিজের কাজটি টেন্ডারের মাধ্যমে হয়েছে। লটারির মাধ্যমে সম্ভবত বরিশাল শহরের বাংলা বাজারের বাসিন্দা এক ঠিকাদার কাজটি পেয়েছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, এক লাখ টাকায় কাজ পূর্ণ করা সম্ভব নয়। 

ঠিকাদারের নাম জানতে চাইলে এই প্রকৌশলী তা জানাতে পারেননি। তবে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রশ্ন করা হয়েছিল, কাজে অনিয়ম না হলে তিন বছর আগে নির্মাণ করা আয়রন ব্রিজটি গেল কোথায়? জবাবে এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, বিস্তারিত ফাইল দেখে বলতে হবে।

এ বিষয়ে জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাওলাদ হোসেন সানা বলেন, মুনশী বাড়ির এক মুরব্বি আমার কাছে এসেছিলেন। তার বাড়িতে যাতায়াতের পথ নেই জানিয়ে একটি ব্রিজের আবেদন নিয়ে। আমি জেলা পরিষদে প্রস্তাব করে তাদের বাড়িতে একটি আয়রন ব্রিজের প্রকল্প পাস করিয়ে দেই। যতদূর জানি প্রকল্প বাস্তবায়নে টেন্ডার হয়েছে। টেন্ডার অনুসারে কাজ হবে, এটা নিয়ম। 

জেলা পরিষদের তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারকে আমি বলেছিলাম, কাজটি ভালোভাবে করার জন্য। তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কাজটি ভালোভাবে করবেন। পরবর্তীতে ঠিকাদার বিল তুলে নিয়ে গেছে কি না বা ইঞ্জিনিয়ার বিল পাস করে দিয়েছেন কি না তা আমার ভালো জানা নেই। কিন্তু ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম আয়রন ব্রিজটি নাকি সেখানে হয়নি। তবে লকডাউন শেষ হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে এনে সমস্যার সমাধান করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন এই জনপ্রতিনিধি।

এসপি