‘সরকার হামাক কি মনে করে? হামরা শ্রমিক, মানুষ নোয়ায়? ঈদের আগোত কত কষ্ট করি বাড়ি আসনো। কালই ফির হঠাৎ করি অফিস, কারখানা খুলি দেবার ঘোষণা। এটা কেমন কথা বাহে। অফিস না করলে হামার চাকরি থাইকপার নায়। বাস বন্ধ থাকলেও হামার চাকরি থাকপে? সরকারোক কন গাড়ি খুলি দেউক।’

রংপুর নগরের মডার্ন মোড়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সোলেয়ান মিয়া। তিনি ঢাকার সাভারের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। তার মতো হাজারো মানুষ ঢাকায় যেতে ওই মহাসড়কে জড়ো হয়েছেন। সবার অপেক্ষা যেভাবেই হোক ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করার। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।

সোলেমান মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‌‌‘রংপুর থাকি যে ঢাকা যামো, গাড়ি কোন্টে? হুট করি লকডাউন দেয়। ফির ইচ্ছা হইলে লকডাউন তুলি নেয়। এটা কেমন কথা, হামার বউ-ছাওয়া তো লকডাউন বুজে না। তামারগুল্যার খাওন দেয়া নাগবে। ওই তকনে ঢাকা হামাক যাওয়ায় নাগবে।’

রোববার (০১ আগস্ট) থেকে শিল্পকারখানা ও গার্মেন্টস স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু হবে এমন সংবাদে কাজে যোগ দিতে হাজার হাজার  শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশার চাকরিজীবীরা রংপুর থেকে রাজধানীর উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।

গণপরিবহন চালু না থাকায় ট্রাক-পিকআপসহ অন্যান্য পরিবহনের জন্য তাদের অপেক্ষা। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তায় বসে-দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পরও মিলছে না গাড়ি। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে সড়কে অবস্থান নিয়ে গণপরিবহন চালুর দাবি জানিয়েছেন তারা। শনিবার (৩১ জুলাই) সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মডার্ন মোড়ে এই চিত্র দেখা যায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকার পথে যাত্রা করতে রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা গার্মেন্টস শ্রমিকরা মডার্ন মোড়ে সড়কের ওপর অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। তাদের দাবি, যাত্রীবাহী পরিবহন চালু করা হোক। নয়তো বাধাহীনভাবে অন্যান্য পরিবহনে ঢাকা যেতে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।

এদিকে সড়কে অবস্থানের সময়ে দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় র‍্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে বিক্ষুদ্ধ জনতা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি ঘিরে রেখে বিক্ষোভ করেন। বিকেল ৩টার পর পরিস্থিতি শান্ত হলে অনেকেই পণ্যবাহী ও খালি ট্রাকে চড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকা পোশাক শ্রমিক শাহানাজ বেগম ও নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী। সাভারের আশুলিয়ায় চাকরি করেন। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থেকে অটোরিকশায় করে রংপুরে আসার পর তারাও ঢাকামুখী গাড়ি না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন। 

ঢাকা পোস্টকে এই দম্পতি বলেন, ‘কাইল হামার কারখানা খুলবে। কারখানা থাকি ফোন করছে। যেমন করি হউক, ঢাকাত যাওয়া নাগবে। যাবার না পাইলে হামার কী চাকরি থাকপে? এমনিতে এই লকডাউনোত হামরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। তারপরও এই কষ্ট দুর্ভোগ লাগি আছে।’

রংপুরের মিঠাপুকুর জায়গীর এলাকা থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য মডার্ন মোড়ে এসেছেন সুরভি আক্তার। তিনি ঢাকার সীরক অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে একটি কারখানায় চাকরি করেন। রোববার (০১ আগস্ট) সকাল ৮টার মধ্যে তাকে কারখানায় উপস্থিত হতে হবে।

এই নারী শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবহন সমস্যার কারণে ঢাকায় যেতে পারছি না। সকাল থেকে গাড়ির জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছি। অনেকেই ট্রাকে, পিকআপ ভ্যানে, কাভার্ডভ্যানে করে যাচ্ছে। কিন্তু আমি যখন গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করছিলাম, তখনই পুলিশ গাড়ি আটকে দেয়। এরপর থেকে তো বিক্ষোভ শুরু হয়। এখন গাড়ির জন্য অপেক্ষায় আছি।

এদিকে বিকেল সাড়ে ৩টার পর মহাসড়কের ওপর থেকে সরে যান বিক্ষুদ্ধ জনতা। এরপর সড়ক কিছুটা ফাঁকা মনে হলেও যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। তবে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হাজারো মানুষ মডার্ন মোড় ও দমদমা ব্রিজ এলাকায় গাড়ির জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া গুনে হলেও ঢাকায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

এ ব্যাপারে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তাজহাট সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনার আলতাফ হোসেন বলেন, শ্রমিকরা ঢাকা যেতে মডার্ন এলাকায় গাড়ির জন্য জড়ো হয়েছিল। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। দীর্ঘক্ষণ ধরে গাড়ির অপেক্ষায় থেকে রংপুর ছাড়তে না পারায় ক্ষুদ্ধ হয়ে তারা সড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর