বাবা পুলিশের এসআই, মেয়ে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন

দুজনের সম্পর্ক বাবা-মেয়ে। ভিন্নতা পেশাগত পরিচয়ে। বাবা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আর মেয়ে চিকিৎসক। সম্প্রতি এই পুলিশ বাবা আর চিকিৎসক মেয়ের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা গেছে তারা একে-অপরকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন (স্যালুট) জানাচ্ছেন! ছবির পেছনের গল্পে জানা গেল, পুলিশ বাবার চিকিৎসক মেয়ে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে চাকরি পেয়েছেন। সে সুবাদে বাবা-মেয়ে অভিবাদন বিনিময় করেছেন। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া বাবা-মেয়ের এই ছবি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই সেখানে বাবা-মেয়ে দুজনকেই প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। পদমর্যাদার চেয়ে রক্তের বন্ধন হৃদয় ছুঁয়েছে সবার। হাজারো মানুষের ভালোবাসা, শুভ কামনা আর অভিনন্দন বার্তায় সিক্ত হচ্ছেন সেনাবাহিনীতে সদ্য চাকরিপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. শাহনাজ পারভীন। তার গর্বিত বাবা এসআই আব্দুস সালামও ভাসছেন প্রশংসায়। 

এসআই আব্দুস সালাম রংপুরের গঙ্গাচড়া মডেল থানায় কর্মরত। তার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার চন্দ্রখানায়। বর্তমানে চাকরির সুবাদে তিনি পরিবার নিয়ে রংপুরে রয়েছেন। 

পরিবারের সঙ্গে এসআই আব্দুস সালাম

সোমবার (০২ আগস্ট) দুপুরে গঙ্গাচড়া মডেল থানায় গিয়ে দেখা হয় এসআই আব্দুস সালামের সঙ্গে। সেখানে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় চিকিৎসক মেয়ের সাফল্যের গল্প শোনান তিনি। গল্প বলতে গিয়ে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে, তবে তা ছাপিয়ে তার উচ্ছ্বাসটাই প্রকাশ পায় বেশি করে। মেয়ের সাফল্যে নিজে গর্বিত হলেও এর কৃতিত্ব দেন স্ত্রী মনোয়ারা বেগমকে। 

আব্দুস সালাম তিন সন্তানের জনক। তার তিন সন্তানই মেয়ে। বড় মেয়ে শাহনাজ পারভীন রংপুর মেডিকেল কলেজের ৪৩তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। সেশন ২০১৩-২০১৪। ইন্টার্নশিপ শেষ করে সম্প্রতি ক্যাপ্টেন পদে চাকরি পেয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। মেজো মেয়ে উম্মে সালমা একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী। সবার ছোট স্মৃতিমনি মীম এসএসসি পরীক্ষার্থী।

আব্দুস সালাম জানান, শাহনাজ পারভীন ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজে। ২০১২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৩-১৪ সেশনে রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান শাহনাজ পারভীন। 

আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‌ ছোট থেকেই সে পড়ালেখায় খুবই মনোযোগী ছিল। বেশিক্ষণ বইখাতা নিয়ে পড়ে থাকত না। যা পড়ত খুব সহজেই মুখস্থ হয়ে যেত। সারাদিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা পড়ালেখা করত। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বা অহেতুক ঘোরাফেরা ছিল না। সারাদিন নিজেকে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে সেই চিন্তাটা ওর (শাহনাজের) মাথায় ঘুরঘুর করত।

আব্দুস সালাম বলেন, আমার সন্তানদের আমি সব সময় সাহস দিয়ে আসছি। ওদেরকে মনোবল বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করি। কোনো কাজ ও বিষয়কে কঠিন করে ভাবতে দিইনি। যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরা এবং আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। মা-বাবাই সন্তানের ভালো চায়, সেটা সন্তান নিজে বাবা-মা না হলে বুঝতে পারবে না। কিন্তু মা-বাবার স্বপ্ন ও চেষ্টাটা তারা যদি উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে প্রত্যেক মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। আমি আমার বড় মেয়ের মতো বাকি দুই মেয়েকেও চিকিৎসক বানাতে চাই। তবে সবকিছুর কৃতিত্ব শাহনাজের মায়ের। সঙ্গে তার শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও রয়েছে।  

তিন মেয়ে নিয়ে এসআই আব্দুস সালাম ও মনোয়ারা বেগমের সংসার

পুলিশে চাকরির কারণে অনেক জেলায় ঘুরেছেন আব্দুস সালাম। কখনো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে। আবার কখনো একা। সন্তানদের প্রতি দায়িত্ববোধ কাজ করলেও তাদের জন্য আলাদা সময় হয়নি তার। এই কষ্টটা এখনো তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তিনি জানান, তিন সন্তানকে দেখভাল ও পড়ালেখায় মনোযোগী করতে তাদের মা মনোয়ারা বেগমের ভূমিকা ছিল মুখ্য। স্বল্প শিক্ষিত হলেও মনোয়ারা সন্তানদের আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সবরকম চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

আব্দুস সালাম ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ পুলিশে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরির সুবাদে রাঙামাটি, খুলনা, ঢাকা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও রংপুরে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে আড়াই বছর ধরে তিনি রংপুরে রয়েছেন।

বাবা-মেয়ের সালাম বিনিময়ের ভাইরাল ছবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আব্দুস সালামের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু অনুভূতি মুখে প্রকাশ করার মতো নয়। আমার ভেতরে যে কী পরিমাণ আনন্দ বিরাজ করছে তা বোঝাতে পারব না। শুধু বলব আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন। 

তিনি বলেন, আমি নিজে বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারিনি। কিন্তু সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করতে চাই। সব মা-বাবাকে অনুরোধ করব, ছেলে-মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেবেন না। সন্তানদের ভালো কিছু দিতে চাইলে তাদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিন।

এদিকে শাহনাজের সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে চাকরিপ্রাপ্তির খবরে আনন্দিত আব্দুস সালামের বর্তমান কর্মস্থলের সহকর্মীরাও। গঙ্গাচড়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুশান্ত কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সবাই আনন্দিত। সন্তানকে নিজের চেয়ে উচ্চ পদে চাকরিতে দেখতে পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করা কঠিন, এমন অর্জন সব বাবার জন্যই গর্বের। আমাদের সকলের উচিত সন্তানের প্রতি সময়োপযোগী আচরণ করা, বন্ধু সুলভ আচরণ বেশি প্রয়োজন। যা এসআই আব্দুস সালামের পরিবারে আছে।’

ফেসবুকে বাবা-মেয়ের ছবি ভাইরাল প্রসঙ্গে রংপুর জেলার পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাবা এসআই আর মেয়ে ক্যাপ্টেন, এটা একজন বাবার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। সন্তানের কাছে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও নৈতিক আদর্শের প্রতীক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারলেই কেবল এ ধরনের অসাধারণ মুহূর্তের উদ্ভব হয়। বাবা-মেয়েকে আন্তরিক অভিনন্দন।’ 

আরএআর/জেএস