মোফাজ্জল হোসেন (৫৫)। বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দি কালিতলা ঘাট এলাকায়। প্রায় ৩০ বছর ধরে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মঙ্গলবার (০৩ আগস্ট) বিকেলে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি গল্পের ছলে বলেন, ‘ছোটকালে বাপের কাচে গপ্পো শুনচি, লেত্রকোনাত হাতি দ্যাকা যায়। যকন বড় হয়ে বাপের লাগান নৌকাত করে মাছ ধরা শুরু করি, তকন হামরা বন্দুরা মিলে ফেরিত চড়ে জামালপুর দিয়ে ময়মনসিং হয়ে লেত্রকোনার কলমাকান্দা গেচি। দুদিন পর বড় দাঁতওলা এডা হাতি দ্যাকচি হামরা। সে কি খুশি হামাকেরে। তাও সেডা হবি ১৯৮৫-৮৬ সালের কতা। তারপর ৮৮’র বন্যা হলো। লদী ভাঙল, দিক বদলালো। আর কত কি হলো। ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। আর চালু হয়নি। হামাকেরে এমপি মান্নান মরে গেচে। তাই কচিলো আবার ফেরি চালু হবি। হয়নি। আবার আসিচ্চে ১২ তারিক নাকি ফেরি চালু হবি। ভালই হবি, লোকজন আসপি যাবি। কাম বাড়বি, মানুষ করে কিনে খাবি।’

জানা গেছে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর ১২ আগস্ট চালু হচ্ছে বগুড়া-জামালপুর নৌপথে ফেরি চলাচল। এ নিয়ে দুই পাড়ের মানুষদের মাঝে আনন্দের জোয়ার বইছে। জোয়ার বইছে বগুড়া জেলা থেকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মাঝেও। এই নৌপথ চালু হলে কম সময়ে উত্তরাঞ্চলের মানুষ ময়মনসিংহ, রাজধানী ঢাকায় যেতে পারবে। এতে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা পথের দূরত্ব কমবে ৮০ কিলোমিটার।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ১৯১২ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ রেলঘাট চালু হয়। তখন মানুষ নৌকায় করে মালপত্র নিয়ে ট্রেনে যাতায়াত করত ঢাকায়। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে তিস্তামুখ থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ রেলঘাট পর্যন্ত ফেরি চলাচল শুরু হয়। বাহাদুরাবাদ রেল ফেরিঘাট থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন ও মালবাহী ওয়াগন চলাচল করত রাজধানী ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলে। সেসময় উত্তরাঞ্চলের মানুষের দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াত প্রধান মাধ্যম ছিল ফেরি সার্ভিস।

এদিকে ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যায় যমুনা নদীর গতি পরিবর্তন হয়। ফলে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। নাব্যতা সংকটে ফেরি সার্ভিসটি তিস্তামুখ ঘাট থেকে বালাসী ঘাটে স্থানান্তর করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল অব্যাহত ছিল। সান্তাহার, বগুড়া, বোনারপাড়া হয়েও ট্রেনের যাত্রীরা এই ঘাট পারাপার হতো। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর প্রথমে যাত্রীবাহী ট্রেন ও পরে মালবাহী ওয়াগন পারাপার বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর শুরু হয় যমুনার এ পাড়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কালিতলা ও মথুরাপাড়া নৌঘাট দিয়ে জামালপুরের মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ ও কাজলাঘাট হয়ে মানুষের চলাচল। বর্তমানে এ পথে নৌকায় প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজারো মানুষ যাতায়াত করে। 

সারিয়াকান্দি থেকে জামালপুরের মাদারগঞ্জ নৌঘাটের দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার। অথচ সড়কপথে মাদারগঞ্জ যেতে হলে সারিয়াকান্দি থেকে ২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে জেলা শহর বগুড়ায় যেতে হবে। বগুড়া থেকে সড়কপথে সিরাজগঞ্জ হয়ে যমুনা সেতু পার হয়ে টাঙ্গাইল জেলা হয়ে জামালপুর যেতে হবে। ফলে বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার যাত্রীদের জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ জেলায় যেতে নানা ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এতে চলাচলকারীদের একদিকে সময় বেশি অপচয় হচ্ছে, অপরদিকে দিতে হচ্ছে অধিক ভাড়া।

সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও জামালপুরের মাদারগঞ্জ নৌপথে ফেরি চালুর জন্য ফেরিঘাট নির্মাণ, সড়ক যোগাযোগ স্থাপন, নাব্যতা ফেরাতে নদী খননসহ নদী সংস্কার ও উন্নয়নকাজে প্রকল্প গ্রহণের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল গত ২৬ মে সারিয়াকান্দি ও মাদারগঞ্জ এলাকা পরিদর্শন করেছেন। জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল ফেরি চালুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আইডব্লিউএমর পরামর্শক মো. মহিউদ্দীন পাটোয়ারি।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি খেয়াঘাট থেকে মাদারগঞ্জের জামথল ফেরি চলাচল আবার শুরু হবে ১২ আগস্ট। ফেরি চলাচল শুরু হলে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা পথের দূরত্ব কমবে ৮০ কিলোমিটার।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভির ইসলামের বাড়ি সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটফুলবাড়ি। তিনি বলেন, নৌকায় ময়মনসিংহ যেতে ভয় লাগে। একবার গিয়েছিলাম। মাদারগঞ্জ নেমে জামালপুর হয়ে ভার্সিটিতে। তবে খুব ভয় লেগেছিল। তারপর থেকে ভার্সিটি যেতে এখন জেলা শহর বগুড়ার চারমাথা বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহের গাড়িতে যাতায়াত করি। ফেরি চালু হলে বাড়ি আসা যাবে। সারিয়াকান্দির ২০-২৫ জন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। তাদের জন্য এটি সুখবর বটে।

সারিয়াকান্দির সিএনজি চালক মানিক মিয়া জানান, ফেরি চলাচল শুরু হলে সিএনজিযোগে সারিয়াকান্দি থেকে ভোরে রওনা হলে দুপুর ২টার মধ্যে জামালপুর, শেরপুর, ললিতাবাড়ী, ময়মনসিংহে পৌঁছানো যাবে। ফেরি চালু হলে কাজ বাড়বে।

সারিয়াকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মুনজিল আলী সরকার বলেন, সারিয়াকান্দি-মাদারগঞ্জ ফেরি চলাচল আমাদের দীর্ঘ দিনের প্রাণের দাবি। উভয় পার্শ্বের ঘাটে প্রায় তিন শতাধিক মোটরসাইকেল আরোহী পরিবহন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ফেরি চলাচল হলে কর্মহীন অনেকের কর্মের ব্যবস্থা হবে। কর্মের সন্ধানে এ পাড়ের মানুষ খুব সহজে ওপারে যেতে পারবে। ১২ আগস্ট এ নৌপথে ফেরি চলাচল করবে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান মতি বলেন, এই পথে ফেরি চালু হলে উত্তরাঞ্চলের মানুষ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাড়াও রাজধানী ঢাকায় কম সময়ে যাতায়াত করতে পারবেন। পাশাপাশি যমুনা সেতুর ওপর চাপ কমবে। ফেরি চালু হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘব হবে।

এসপি