স্বপ্নের ফ্ল্যাটের বদলে কারাগারে ঠাঁই, হাতিয়ে নিয়েছে সব সঞ্চয়
ষাটোর্ধ্ব মদিনা বিবি থাকেন সাভারের ভাড়া বাসায়। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে সংসার চলে তার। তবে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে তিনি ফ্ল্যাটের আশায় হারিয়েছেন সর্বস্ব। সর্বশেষ কারা ভোগ করতে হয়েছে তাকে। প্রতিবেশী তুষার ও তার কথিত আত্মীয় মামুনের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে মদিনা বিবিসহ অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন।
সম্প্রতি এমনই ঘটনা ঘটেছে সাভারের ব্যাংক কলোনী এলাকায়। এখানে ফ্যামিলি মুদি বাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছিল। এই ফ্যামিলি মুদি বাজারে প্রতিদিন কিস্তিতে পণ্য বিক্রি হতো। শর্ত ছিল প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ টাকা দিতে হবে। পরবর্তীতে ফ্যামিলি বাজারের সদস্যদের ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৪৭৫ টাকা করে জমা নেওয়া হয়। এ খবরে অনেকে লোভে পড়ে ৫ থেকে ১০টি বইয়ের মাধ্যমে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা জমা রাখতেন প্রতি মাসে। তবে প্রতারণা করে সবার টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছেন মামুন।
বিজ্ঞাপন
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে সাভার ব্যাংক কলোনি এলাকায় স্ত্রীসহ ভাড়া বাসায় থাকেন তুষার। সেখানে তার স্ত্রীর মুদি ও টেইলার্সের দোকান রয়েছে। বায়িং হাউসে কাজ করতেন তুষার। তিনি প্রতিদিন চাকরির কাজে যেতেন নারায়ণগঞ্জে। সেখানে মামুন নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তুষার তাকে স্ত্রীর ভাই পরিচয় দিয়ে সাভার ব্যাংক কলোনি এলাকায় এনে বসান দোকানে। সেখানে মামুন ও তুষার মিলে খুলে বসেন প্রতারণার ব্যবসা। ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলে প্রায় দুই শতাধিক নিরীহ মানুষের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। টাকা চাইলে কৌশলে ব্যাংকের চেক নিয়ে ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে দিয়েছেন চেক জালিয়াতির মামলা। এই মামলায় জেলও খেটেছেন মদিনা বিবি।
এ ব্যাপারে মদিনা বিবি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তুষার আমাদেরকে মামুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেখানে মুদির মালামাল আমরা কিস্তিতে কিনতে থাকি। পরে ফ্ল্যাটের লোভ দেখিয়ে বইয়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৪৭৫ টাকা করে নেয় মামুন। একদিন মামুন আমাকে নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলে। সে শুধু আমার স্বাক্ষর নেয়। আমি কিছুই বুঝি না। পরে ব্যাংক এক কপি বই দেয়, ভেবেছিলাম মামুনেরই বই। আমার স্বাক্ষর নিয়ে বইয়ের একটি পাতা নিয়ে যায় মামুন। কিন্তু মামুন পালানোর পর পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। কারাগারে থাকতে হয়। পরে ছাড়া পেতে আমার ১৩ হাজার টাকা লেগেছে। এখনও যেতে হয় আদালতে।
বিজ্ঞাপন
মামুনের বাড়ি বরিশাল জেলায় হলেও তার জাতীয় পরিচয়পত্রে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার হিরাঝিল এলাকা। এই ঠিকানা ব্যবহার করে আরও তিনজনের বিরুদ্ধে সিআর মামলা করেছেন তিনি। তারাও মামুনের কাছে ফ্ল্যাট কেনার জন্য টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আবার তাদের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকেছেন মামুন।
মামলার আসামিরা হলেন- সবজি বিক্রেতা মিজানুর রহমান, স্যানিটারি মিস্ত্রি মনমিয়া ও সুমন মিয়া। তবে এ ঘটনায় বাদী পক্ষে সাক্ষী করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মো. হাফিজুর রহমান ও রাজধানীর আদাবর থানার বাসিন্দা মোজাফফর আহমেদকে।
ভুক্তভোগী তিনজন বলেন, আমাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা ছিল। তাই তার কাছে কেউ ১০ বই, কেউ ১৩ কেউ ৬ বই করে প্রতি বইয়ে ৪৭৫ থেকে ২ হাজার পর্যন্ত সঞ্চয় রেখেছি। পরে ফ্ল্যাট দেওয়ার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করার কথা বলে টাকা জমার রশিদ, বইসহ সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে পালিয়েছে মামুন। পরে আমাদের বিরুদ্ধেই সিআর মামলা করেছে।
এছাড়াও স্থানীয় আইসস্ক্রিম বিক্রেতা দুলাল ও দুলালের মা হাসনারা বেগমের কাছে মামলার ভয় দেখিয়ে বিকাশে টাকা চায় মামুন। বিকাশ নম্বরগুলো হলো ০১৮০৩৬৯৯০৩ ও ০১৭৮৭৩০৭০১৭। অনেকে মদিনা বিবির কথা চিন্তা করে টাকা পাঠান। এছাড়া শাহ আলমের ২ লাখ, মঞ্জুয়ারা বেগমের ২০ হাজার ও জোসনা বেগমের ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মামুন।
ফ্যামিলি মুদি বাজার থেকে ১০ শতাংশ মুনাফার আশায় জায়গা দিয়েছিলেন তুষার। অভিযুক্ত তুষারের স্ত্রী নাসরিন বলেন, আমাদের দোকানে মালামাল তুলে দিতে চেয়েছিল মামুন। আমি তাকে কোনো দিন দেখি নাই। আমার স্বামী নারায়ণগঞ্জে চাকরির সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তিনি এই এলাকায় আমার ভাই পরিচয় দিয়ে তাকে এনেছিলেন। ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকে আমার স্বামীই সকল সদস্যদের জোগাড় করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমার স্বামী তাকে ভালোর জন্যই এনেছিল। তিনি এমন প্রতারণা করবেন এটা তো আমরা জানতাম না।
এ ব্যাপারে মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে একজন নারী ফোন রিসিভ করেন। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করেন এটি মামুনের ফোন নম্বর। তবে তিনি ঘুমিয়েছেন। কথা বলতে হলে পরে ফোন দিতে হবে। পরবর্তীতে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ এখনও থানায় আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাহিদুল মাহিদ/আরএআর