আমেনা খাতুন মুক্তি

ঘনিষ্ঠ হয়ে জিম্মি করতেন তিনি। কতিপয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা। আর এ সম্পর্কের জেরে গড়ে তুলেছেন বিশাল নেটওয়ার্ক। মাদক ব্যবসা ছাড়াও চাঁদাবাজি ও ফিটিং মামলা এ চক্রের প্রধান কাজ।

কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রাজশাহী জেলা পুলিশের জালেই আটকা পড়লেন চক্রের হোতা আমেনা খাতুন মুক্তি (৩৭)। পুলিশের ওই অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে তার ছেলে শাহরিয়ার ওরফে জয় (২২) এবং কথিত স্বামী নুরুজ্জামান ওরফে কাজল (৩৫)।

গত সোমবার (২ আগস্ট) রাতে জেলার গোদাগাড়ী পৌরসভার রেলবাজার এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে জেলা পুলিশ। এ অভিযানে অংশ নেয় গোদাগাড়ী মডেল থানা পুলিশের একটি দল।

অভিযুক্ত আমেনা খাতুন মুক্তি গোদাগাড়ীর মাদারপুর রেলবাজার খাদ্যগুদাম এলাকার মৃত মতিউর রহমান মতির স্ত্রী। গ্রেফতার নুরুজ্জামান কাজল উপজেলার মহিশালবাড়ি এলাকার মৃত নাসির উদ্দিনের ছেলে।

শাহরিয়ার ওরফে জয়

এলাকাবাসীর অভিযোগ, মুক্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। এ পরিচয়ে মাদক ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন তিনি।একই কাজে যুক্ত ছিলেন কাজল। তারা দিনে দুপুরে মানুষকে মাদক মামলায় ফাঁসাতেন। 

পুলিশ কর্মকর্তা ভাইয়ের পরিচয়ে এলাকায় বেপরোয়া ছিলেন কাজল। একই পথের পথিক হওয়ায় মুক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বেধেছিলেন।তবে তাদের সম্পর্ক নিয়ে এলাকা রয়েছে ধোঁয়াশা।

সূত্র জানাচ্ছে, মাদক ব্যবসা ছাড়াও অনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন মুক্তি। আর তার ছেলে জয় এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিশাল কিশোর গ্যাং। কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে মাদক বিক্রি ও ছিনতাইয়েও যুক্ত জয়। আর এ কাজে তার প্রধান সহযোগী গোদাগাড়ী পৌর এলাকার বুজরুক পাড়া মহল্লার মাদক ব্যবসায়ী সোহান।

জয়ের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক গড়েন সোহান। সোহানের বাবা সাইদুর রহমানও কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। এলাকায় তার পরিচিতি ফেন্সি সাইদুর নামে। তাদের বাবা-ছেলের নামেও রয়েছে থানায় একাধিক মাদকের মামলা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মুক্তির বাবার বাড়ি গোদাগাড়ীর সরাংপুরে। পেশায় জেলে ছিলেন তার বাবা। রূপবতী মুক্তি যৌবনে যুক্ত হন মাদক সিন্ডিকেটে। শুরুতে এলাকার মাদক কারবারের গডফাদাররা তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতেন কতিপয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাকে বাগে আনতে।

এক পর্যায়ে সেই কৌশল রপ্ত করে নিজেই বনে যান অপরাধ রাজ্যের রাণী। দিনে দিনে গড়ে তোলেন শতাধিক নারী নিয়ে আলাদা নেটওয়ার্ক। এ চক্রে যুক্ত নারীদের প্রত্যেকের বয়স ৩০ বছরের মধ্যে। সুন্দরী এসব নারী এসেছেন দরিদ্র্য পরিবার থেকে।

এদের মধ্যে যারা বিবাহিত তাদের অধিকাংশের স্বামী মাদকাসক্ত। সংসার চালানো এমনকি স্বামীদের মাদকের টাকা যোগাতে তারা এ পথে নামেন। মাদক ডিলারদের মনোরঞ্জন করে বাকিতে মাদক এনে খুচরা বিক্রি করেন এসব নারী।

রেলবাজার খেয়াঘাট এলাকার আজিজুল ইসলামের মেয়ে নারী মাদক ব্যবাসয়ী কারিমা খাতুন, মাদারপুর ডিমভাঙা এলাকার রীনা খাতুন, মহিশালবাড়ি ফকিরাপাড়া এলাকার মৃত ডলারের স্ত্রী ইয়াসমিন এবং ফাতেমা খাতুন ওরফে ফুরকনের রয়েছে প্রায় একই ধরনের আলাদা মাদক নেটওয়ার্ক।

এ কারবারে যুক্ত থেকে রাতারাতি বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন এসব নারী ও তাদের স্বজনরা। গত পৌর নির্বাচনে মুক্তি ও ফুরকন নারী কাউন্সিলর পদে অংশ নেন। তাদের হয়ে চক্রের নারী সদস্যরা প্রচারণায় নেমে আলোচনার জন্ম দেন।

এদিকে, আমেনা খাতুন মুক্তি গ্রেফতারের পর তার অপরাধ রাজ্যের নানান তথ্য বেরিয়ে আসছে। অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিওধারণ করে গোদাগাড়ী মডেল থানার এক কর্মকর্তাকে জিম্মি করার অভিযোগ রয়েছে মুক্তির বিরুদ্ধে। মোটা টাকা দিয়ে সেই যাত্রায় রক্ষা পান সেই পুলিশ কর্তা।

জানা গেছে, অবৈধ টাকার ছড়াছড়িতে বেপরোয়া জীবন যাবন করেন মুক্তি। বিয়ে করেছেন ৭টির অধিক। সর্বশেষ নুরুজ্জামান কাজলকে বিয়ের খবর এলাকায় প্রচার হয়। এর আগে তিনি মাদারপুর রেলবাজার খাদ্যগুদাম এলাকার সৈয়দ আলীর ছেলে মতিউর রহমান মতিকে বিয়ে করেন। ৫ বছরের সংসারে তার দুই ছেলে রয়েছে।

নুরুজ্জামান কাজল

এলাকাবাসী নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, মুক্তির স্বামী মতি একসময় রেলবাজার খেয়াঘাটের ইজারাদারদের ফুট ফরমায়েশ খাটতেন। ওই সময় চোরাচালানেও যুক্ত ছিলেন। এলাকায় নারী কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে সালিসে মারধরের শিকার হন মতি।

এরপর লোকলজ্জায় এলাকা ছেড়ে ঢাকায় যান। সেখান থেকে পাড়ি দেন বিদেশে। ৫ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে যুক্ত হন মাদক সিন্ডিকেটে। তখনেই ঘনিষ্টতা থেকে বিয়ে করেন মুক্তিকে।

এরপর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স পরিচয়ে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা শুরু করেন মতি। মাদক ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মতি খুন হন। এরপর থেকেই আগের পক্ষের ছেলেদের নিয়ে অনেকটা প্রকাশ্যে স্বামীর কর্মকাণ্ডে নামেন মুক্তি।

আরেকটি সূত্র বলছে, মাদক ব্যবসায় আধিপত্য নিয়ে গোদাগাড়ীর আরেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও পৌর কাউন্সিলর মোফাজ্জল হোসেন মোফার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন মুক্তি। সম্প্রতি ওই কাউন্সিলরকে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে মুক্তির বিরুদ্ধে। এর আগেও স্বজনরা কাউন্সিলের বাড়িতে মাদক রেখে তাকে ফাঁসানোর অভিযোগ আনেন মুক্তির বিরুদ্ধে।

তবে এ নিয়ে পুলিশের কাছে তেমন তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন গোদাগাড়ী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গ্রেফতার এই তিন জনের নামে আগে থানায় কোনো মামলা নেই।

৩০ জুলাই গোদাগাড়ী মডেল থানার একটি মাদকের মামলায় পলাতক আসামি মুক্তি ও তার ছেলে জয়। মামলা নম্বর ৪৭/জুলাই। এছাড়া ৩ জুন দায়ের করা মাদকের আরেকটি মামলায় আসামি ছিলেন কাজল। মামলা নম্বর ১০/জুন।

বিপুল পরিমাণ মাদকসহ গ্রেফতারের পর তাদের সহযোগীরা পুলিশকে তথ্য দেন। এরপরই অভিযান চালিয়ে তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে উঠা অন্যান্য অভিযোগগুলো পুলিশ খতিয়ে দেখবে বলেও জানান ওসি।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস