৫০ শিশুর মুখে প্রতিদিন খাবার তুলে দেয় কৃষকের রান্নাঘর
আব্বু মারা গেছে অনেক দিন। আম্মু বাড়িতে টুকটাক কাজ করে। কোনো দিন খাওয়া হয়, আবার কোনো দিন না খেয়েই থাকি। কিন্তু না খেয়ে থাকলেও কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আমাদের। দেড় মাস ধরে প্রতিদিন দুপুরে মাছ-মাংস দিয়ে ভাত খেতে দেয়। এতে আমি খুব খুশি। একসঙ্গে এত দিন ধরে ভালো খাবার কখনো খাইনি।
কৃষকের রান্নাঘরে বসে এভাবেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিল ১০ বছর বয়সী শিশু মিতু আক্তার। বাবার মৃত্যুর পর করোনাকালীন পরিবারে আয়-রোজগার বন্ধ হওয়ায় সে প্রতিদিন দুপুরে এসে এক বেলা খাবার খায়।
বিজ্ঞাপন
করোনাকালীন লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েন বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রামের কৃষক-দিনমজুররা। এতে তারা পরিবারে খাদ্যের জোগান দিতে পারেন না। ফলে তাদের সন্তানরা অভুক্ত থাকে। সেই উপলব্ধি থেকেই গত ২৪ জুন থেকে এমন অভুক্ত অর্ধশতাধিক শিশুর মুখে প্রতিদিন দুপুরে খাবার তুলে দিচ্ছে ‘কৃষকের রান্নাঘর’।
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ফজলুল বারীর সংগঠন ‘অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের’ অর্থায়নে ও ডেমা ইউনিয়ন কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির আয়োজনে এই কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন, সমবায় সমিতি, এলাকাবাসী ও স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহায়তায় চলছে এই কার্যক্রম।
সরেজমিনে শনিবার (১৪ আগস্ট) কার্যক্রমের ৪৯তম দিনে কৃষক শেখ তানজিমের বাড়িতে দেখা যায়, ৫৫ জন শিশুর সঙ্গে দুজন বৃদ্ধ খাবার খাচ্ছিলেন আনন্দমুখর পরিবেশে। খাদ্যতালিকায় কখনো পোলাও, কখনো খিচুড়ি, কখনোবা সাদা ভাত। সঙ্গে থাকে ডিম, সবজি, ডাল, মাছ, মাংস।
বিজ্ঞাপন
কৃষকের রান্নাঘরে খাবার খেতে আসা আলিফ নামের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, বাড়িতে খাবার নেই। তাই ক্ষুধা লাগলে এখানে চলে আসি। এখানে সবাই মিলে একসাথে খাবার খাই। খুব ভালো লাগে।
ভ্যানচালক হাফিজুর রহমানের ছেলে রবিউল বলে, করোনার মধ্যে একদিন এখানের এক কাকা আমারে ডাইকে নিয়ে আইসে দুপুরের খাবার দেয়। এরপর থেকে দুপুর হলেই আমি প্রতিদিন এখানে চলে আসি। আমাকে খেতে দেয়। মজা করে পেট ভরে খাবার খাই।
শুধু রবিউলই নয়, তার মতো অনেক দরিদ্র পরিবারের শিশুরা কৃষকের রান্নাঘরে এসে পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে। আবার দরিদ্র কৃষক-দিনমজুরা এখানে এলে তাদেরও খাবার খাওয়ানো হয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় শাজাহান আলী বলেন, আমাদের গ্রামে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সব এলাকায় যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে কোনো শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে না। আমি চাই এই কার্যক্রম যেন সামনের দিনেও চলমান থাকে।
শিশুদের খাবার রান্নার কাজে নিয়োজিত শেফালি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার এ সময়ে গ্রামের অনেক অসহায় পরিবার বিপাকে রয়েছে। অনেক পরিবারের শিশুরা রয়েছে অভুক্ত। তাদের দেখলে আমার খারাপ লাগে। তাই কষ্ট হলেও প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জনের খাবার রান্না করি। শিশুরা যখন পেট ভরে খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়, আমার সব কষ্ট পানি হয়ে যায়। রান্নার কাজে আরও পাঁচজন প্রতিবেশী স্বেচ্ছায় সাহায্য করে বলে জানান তিনি।
কৃষকের রান্নাঘরের অন্যতম উদ্যোক্তা কৃষক শেখ তানজিম তানজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালীন আমাদের গ্রামের কৃষকরা কর্মহীন হয়ে পড়েন। সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে চলে তাদের জীবনযাপন। এ অবস্থায় কৃষকদের সন্তানদের এক বেলা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাদের এই উদ্যোগের কথা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে অস্ট্রেলিয়ানপ্রবাসী ফজলুল বারীর সংগঠন অমর্ত্য ফাউন্ডেশন আমাদের পাশে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, গত ২৪ জুন থেকে গ্রামের অসহায় পরিবারের ৫০ শিশুকে নিয়ে দুপুরের খাবারের আয়োজন করি। প্রতিদিন খাবারে আমাদের দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এলাকাবাসী ও বিত্তবানদের সহায়তায় এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ডেমা ইউনিয়ন কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির সভাপতি শেখ আসাদুজ্জামান বলেন, কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার শেষ নেই। আমরা গ্রামের কৃষকরা উদ্যোগ নিয়ে এই সংগঠন গড়ে তুলি এবং হতদরিদ্র পরিবারের অবস্থা চিন্তা করে তাদের সন্তানদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করি। শুধু খাবার দিয়েই নয়, আমরা শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষায় ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যাতে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কষ্ট করতে না হয়।
ডেমা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনি মল্লিক বলেন, দেড় মাসের বেশি সময় ধরে কৃষকের রান্নাঘরের মাধ্যমে প্রতিদিন দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি তাদের এই কর্মকাণ্ডকে স্বাগত জানাই। এ ধরনের কার্যক্রমে আরও অনেক মানুষ এগিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তানজীম আহমেদ/এনএ