প্রশংসায় ভাসছেন পদ্মা নদীতে পড়ে যাওয়া মা ও শিশুসন্তানের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করা সেই মো. মনির শেখ (৪০)। গত শুক্রবার (১৩ আগস্ট) সকালে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার ৫ নং ফেরিঘাটের পন্টুন থেকে পড়ে যান রোকসানা ইয়াসমিন ও তার চার বছর বয়সী শিশুসন্তান মেহেরাব। চোখের সামনে ঘটনাটি দেখে নিজের জীবন বাজি রেখে উত্তাল পদ্মায় ঝাঁপ দিয়ে তাদের উদ্ধার করেন মনির।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের বাহিরচর দৌলতদিয়ার সাত্তার মেম্বার পাড়ায় পদ্মা পাড়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন মনির। তার বাবা কবে মারা গেছেন, মনে নেই তার। বয়স যখন ১২ বছর, তখন হারান মাকে। তারপর থেকেই ঘাটই যেন তার ঘরবাড়ি। ১৮-১৯ বছর ধরে লস্কর (শ্রমিক) হিসেবে এই ঘাটে কাজ করেন তিনি। ধন-সম্পদ বলতে কিছুই নেই তার। পদ্মায় দুবার নিজের বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। এখন অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ছোট একটি ছাপড়ায় বসবাস করেন মনির।

এই মহানুভবতার বিষয়ে জানতে কথা হয় মনির শেখের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার জন্মস্থান এই দৌলতদিয়ায়। জন্মের পর থেকে আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে এই ঘাটে। বাবার অসচ্ছলতার কারণে পড়ালেখা করতে পারি নাই। তাই জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রায় ১৮-১৯ বছর ধরে এই ঘাটে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এই ঘাটেই থাকি। ফেরি ঘাটে ভেড়ার পর তা রশি দিয়ে পন্টুনে বাঁধি, ফেরি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ধোয়ামোছার কাজ করি। ফেরিতে গাড়ি লোড-আনলোডের সময় সিরিয়াল রাখার কাজ করি। ফেরিতে ওঠার যানবাহনগুলোর টিকিট চেক করি।

প্রতিদিনের মতো গত শুক্রবার সকালে কাজের উদ্দেশ্যে ঘাটে আসি। তখন বাজে সকাল ৯টা। ৫ নং ফেরিঘাটে পন্টুনের পাশেই দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছিলাম। ঠিক সে সময় মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে আসা ফেরি আমানত শাহ ৫ নং ফেরিঘাটে ভেড়ে। ফেরিটি ফাঁকা হলে যাত্রী ও যানবাহন উঠতে থাকে। আমি পাশেই দাঁড়িয়েই যানবাহনগুলোর টিকিট চেক করছিলাম।

এ সময় ফেরি আমানত শাহতে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস পন্টুনে ওঠার সংযোগ সড়ক র‌্যামের একদম কিনার দিয়ে ফেরিতে উঠছিল। ঠিক তখনই শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ফেরিতে উঠছিলেন এক গৃহবধূ। বাসটি তাদের প্রায় শরীর ঘেঁষে যাওয়ার সময় ভারসাম্য রাখতে না পেরে তারা উত্তাল পদ্মায় পড়ে যান। পদ্মায় ছিল তখন তীব্র স্রোত। স্রোতের ঘূর্ণিপাকে পড়ে ভেসে যাচ্ছিলেন তারা।

হঠাৎ বিষয়টি চোখে পড়ে আমার। দ্রুত লাফ দিয়ে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করি। বিষয়টি দেখার পর রোকসানার স্বামীও পদ্মায় লাফ দিয়ে আমাকে টেনে তোলেন। এরপর প্রাণে বেঁচে যান রোকসানা ও তার শিশুসন্তান।

মনিরের এই মানবিকতার ঘটনাটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রশংসা পেতে থাকেন তিনি। মনিরের এই মানবিকতার জন্য স্থানীয় ব্যক্তিরাসহ ধন্যবাদ জানায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় প্রশাসন।

দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. আশরাফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মার ভাঙনে সবকিছু হারিয়েছেন মনির। নিজের বসতবাড়িও নেই তার। সাহসী একটি কাজের মাধ্যমে মনির সারা দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে। পদ্মায় এখন তীব্র স্রোত বহমান। মনিরেরও বিপদ হতে পারত। কিন্তু এসব চিন্তা বাদ দিয়ে দুটি জীবনকে বাঁচতে সহায়তা করেছেন তিনি।

দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে দায়িত্বরত সংবাদকর্মী দেবাশীষ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেখানে রোকসানা ও তার শিশু ঝাঁপ দিয়েছিলেন, সেটা ছিল পল্টুনের নিচে। সেখানে তীব্র স্রোত। তারা জলে ভাসছিল। কিন্তু মনির দ্রুত লাফ দিয়ে তাদের টেনে ধরেন। এরপর তার স্বামী মনিরকে টেনে ধরেন। এরপর স্থানীয়দের সহায়তার তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। আর ১০ সেকেন্ড সময় দেরি হলে হয়তো দুজন মানুষ পদ্মায় হারিয়ে যেতেন।

মনির বলেন, পদ্মা পারের মানুষ আমি। দুইবার পদ্মায় আমার বসতবাড়ি ভেঙে গেছে। এই পদ্মায় পড়ে গিয়ে অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার চোখের সামনে শিশুসহ এক মা স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন, এটা দেখে কীভাবে বসে থাকি? তারা আমার স্ত্রী-সন্তান হলে বসে থাকতে পারতাম? আল্লাহ আমাকে ওই সময় জ্ঞান দিছিল। তাই আমি তাদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারছি। সারারাত ঘুামাইতে পারি নাই। ওই দৃশ্য শুধু চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে ভাঙন রোধে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

উদ্ধার হওয়া রোকসানা ইয়াসমিনের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাসাইলা কুসা ইসাপুর গ্রামে। তার স্বামীর নাম মো. হাসানুজ্জামানের স্ত্রী। রোকসানার বাবার বাড়ি খানখানাপুর।

হাসানুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আল্লাহ মনির ভাইয়ের মধ্যে আলাদা একটা শক্তি দিয়েছিলেন। তাই তিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আমার স্ত্রী ও চার বছরের শিশুসন্তানকে উদ্ধার করেন। পরে আমি নিজেও নদীতে ঝাঁপ দিই। দুজনের সহায়তায় আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে ও মনির ভাই ছিলেন বলেই আমি আমার স্ত্রী-সন্তানকে ফিরে পেয়েছি। মনির ভাই গরিব হলেও অনেক বড় মনের মানুষ। দোয়া করি তিনি বেঁচে থাকুন।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা মুন্সী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মনির সাহসী ও মানবিক একটি কাজ করেছেন। এমন কাজের কারণে তিনি দেশব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, মনিরের নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি নেই। তার বাড়ি পদ্মায় ভেঙে গিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে একটি ঘর দেওয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এনএ