সমাজপতিদের কড়া নির্দেশনা এদের বাড়ি যাওয়া যাবে না। এদের সঙ্গে বসা যাবে না। তাদের দোকান থেকে কেনাকাটাও করা যাবে না। যে কেনাকাটা করবে সেই হবে সমাজচ্যুত। সমাজপতিদের এমন সিদ্ধান্তে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কোরবানপুর গ্রামের তিনটি পরিবার নয় মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে আদালতে মামলা করায় সমাজচ্যুত করে রাখা হয় তিন ভাই কাজল আহমদ, আকমল হোসেন ও শফিকুল ইসলামের পরিবারকে। এ নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী পরিবার।

ভুক্তভোগীর পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, জায়গা সংক্রান্ত বিষয়ে তার দাদা উমর আলীর ভাই তোরাব আলীর নাতী পাখি মিয়ার সঙ্গে বিরোধ চলছিল। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সালিশকারী ও পঞ্চায়েত কমিটিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে গেলে তারা উভয়পক্ষের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা জামানত নিয়ে সালিশের সময় দেন ২০২০ সালের ১৯ জুন। সালিশের দিন জায়গার কাগজপত্র নেন। সালিশে তিনি কাগজ অনুযায়ী ন্যায়বিচারের দাবি করেন। রেকর্ডে এক শতাংশ জায়গার মালিক হলেও গ্রাম্য পঞ্চায়েতে সালিশকারীরা তাদের জায়গা বুঝিয়ে দেননি। ফলে ন্যায়বিচারের জন্য গত ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে স্বত্ব মামলা (মামলা নং ৯৭/২০২০ ইং) দায়ের করেন। আদালতে মামলা করায় সালিশকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর কোরবানপুর গ্রাম থেকে সমাজচ্যুত করে পঞ্চায়েত কমিটি। সমাজচ্যুত হওয়া তিন ভাই কাজল আহমদ, আকমল হোসেন ও শফিকুল ইসলাম পরিবার এখন দিশেহারা।

সমাজচ্যুত হওয়া কাজল আহমদ বলেন, সমাজচ্যুত করার কারণে গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে চরম দুর্ব্যবহার, স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায়সহ বিভিন্ন কাজে বাধাবিপত্তি দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লোকজন না আসা এমনকি গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা-বার্তা বলতে দেওয়া না। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পরিচালনা করা যাচ্ছে না। 

তিনি বলেন, এ বিষয়ে মৌলিক অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিবাদী পাখি মিয়া, পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নজরুল মিয়া, সদস্য চেরাগ মিয়া, চুনু মিয়া, হান্নান মিয়া, কাদির মিয়ার নাম উল্লেখ করে সমাজচ্যুত করার কারণ জানতে চেয়ে একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করি। ঐ লিগ্যাল নোটিশের কোনো সন্তোষজনক জবাব তারা দেয়নি। তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোয় আরও ক্ষিপ্ত হয়ে সালিশকারীরা আরও পাঁচ বছরের জন্য চূড়ান্তভাবে সমাজচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নজরুল মিয়া প্রভাবশালী লোক। তার বিরুদ্ধে এলাকায় কেউ কথা বলতে চায় না। তার বিরুদ্ধে কেউ গেলে তাদেরকেও সমাজচ্যুত করা হয়। সালিশে আমাদের জমাকৃত টাকা ও জায়গার কাগজপত্রও সালিসকারীরা আমাদের এখনো বুঝিয়ে দেননি।

কাজল আহমদ বলেন, বর্তমানে আমার সন্তানরা মক্তবে গিয়ে কুরআন শিক্ষাও করতে পারছে না। তাদেরকে সমাজের অন্যরা হেয় করে কথা বলে। সন্তানরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদেরকে সমাজচ্যুত করার পর থেকে প্রশাসন, থানা পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিসহ সবার কাছে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। আমাদেরকে মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দিচ্ছে। কাউকেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছে না পঞ্চায়েত কমিটি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামবাসীরা জানান, সালিশকারীরা এলাকার লোকদেরকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে না যাওয়ার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ দিয়েছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গেলে তাদেরও পরিণতি তার মতো হবে। সমাজচ্যুত করার পর মসজিদের ইমামের বেতন ও মক্তবের জন্য সাপ্তাহিক যে চাঁদা নেয়া হতো তাও নিতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি সমাজচ্যুত হওয়া পরিবারের কেউ মারা গেলে বা অসুস্থ হলে বাড়িতে না যাওয়ার জন্য পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়। এসব নিয়ে যে কথা বলবে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়।

এ বিষয়ে গ্রাম্য পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নজরুল মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার আমাদের নেই। তারা মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনও তদন্ত করছে।

কুলাউড়ার ভূকশীমইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, এই পঞ্চায়েত কমিটির মধ্যে সমস্যা আছে। তারা একেক সময় একেক পরিবারকে সমাজচ্যুত করে।

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, আইনগতভাবে রাষ্ট্রে কোনো নাগরিককে সমাজচ্যুত করে রাখার অধিকার কারো নেই। বর্তমান সময়ে এ রকম ঘটনা সত্যিই মর্মান্তিক। সভ্য সমাজে এ ধরনের সমাজচ্যুতের ঘটনা ঘটতে পারে না। আমি ভূক্তভোগী পরিবার ও পঞ্চায়তের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি।

ওমর ফারুক নাঈম/ওএফ