যোগদানের ৪ মাসে থানার চিত্র পাল্টে দিলেন ওসি
পাবনার আতাইকুলা থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেওয়ার চার মাসের মাথায় জনগণের প্রত্যাশা প্রায় শতভাগ পূরণ করেছেন জালাল উদ্দিন। সন্ত্রাস, মাদক আর গরু চোরদের আখড়া বলে পরিচিত থানা এখন অনেকটাই অপরাধমুক্ত। ইতোমধ্যে কর্মদক্ষ ওসি তার কাজ দিয়ে বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেছেন। প্রশংসিত হচ্ছেন সর্বমহলে।
গত (১৩ জুন) পাবনা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় তাকে বিশেষ পুরস্কার দেন জেলা পুলিশ। এর আগেও তিনি বিভিন্ন থানা থেকে ভালো কাজে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন।
বিজ্ঞাপন
থানায় যোগদানের পর থেকেই কমে গেছে দালালদের দৌরাত্ম্য। প্রাথমিক অবস্থায় দালালদের সতর্ক করে থানায় তদবিরের জন্য না আসতে বলে দিয়েছেন তিনি। সেবা প্রার্থীরা দালাল ছাড়াই নির্দ্বিধায় থানায় আসা-যাওয়া করতে পারছেন। জিডি করতেও এখন আর টাকা লাগছে না থানায়। নারী-পুরুষ সবাই অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করছেন ওসির রুমে।
বিজ্ঞাপন
২০০১ সালের ১৮ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম পাবনা জেলার সাঁথিয়া, আটঘরিয়া ও পাবনা সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে আতাইকুলা থানার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর থেকেই থানাটি অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ থানা এলাকা একটা সময় সন্ত্রাসী এবং চরমপন্থী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে সারাদেশে পরিচিত ছিল। সন্ধ্যার পর কেউ বাড়ির বাইরে বের হতে পারেতন না।
ধীরে ধীরে সন্ত্রাস কমে গেলেও মাদক ব্যাপক আকার ধারণ করে আতাইকুলা থানা এলাকায়। গ্রামসহ মুদি দোকানেও মাদক কেনাবেচা হতো। পাড়ায়-পাড়ায় বসত জুয়ার আসর। কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের মদদে এলাকায় মাদক ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠে।
এতে মহল্লায় মহল্লায় বেড়ে যায় গরু চুরি। অনেক গ্রামের মানুষ গোয়াল ঘরে রাতযাপন শুরু করেন। গরু চোরকে হাতেনাতে ধরলেও কিছু পুলিশ সদস্য এসে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। তাছাড়া মহাসড়কে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। চাঁদা না দিলে বেধড়ক মারধর করা হতো চালকদের।
চলতি বছরের (৩০ এপ্রিল) পাবনার আতাইকুলা থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন জালাল উদ্দিন। তার যোগদানের পরই যেন রাতারাতি পাল্টে গেছে আতাইকুলা থানার দৃশ্যপট। থানার ভেতরে বাইরে পরিবর্তন লক্ষণীয়। মাদ্রক সম্রাট-সম্রাজ্ঞীরা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। পাড়ায় পাড়ায় জুয়ার আসরও উধাও। হাট-বাজারে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোয় রাতে দোকানপাটে চুরি বন্ধ হয়েছে, অপরাধ কমেছে। বিল ও নিচু এলাকার আবাদি জমিতে জলাবদ্ধতা নিরসনেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
চাঁদাবাজদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আতাইকুলা, মাধপুর, বনগ্রাম, কুচিয়ামোড়া, দুবলিয়া, পুষ্পপাড়া, গঙ্গারামপুরসহ বিভিন্ন বাজারে লাঠিয়াল বাহিনী গা ঢাকা দিয়েছে। সব হাট-বাজারে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। থানায় বসেই ২৪ ঘণ্টা পুরো আতাইকুলা থানা নজরদারি করা হয়।
আতাইকুলা বাজারে কৌশলে যানজট তৈরি করে সিরিয়াল পর্যন্ত বিক্রি করত চাঁদাবাজরা। এখন যানজটমুক্ত আতাইকুলা বাজার এলাকা। এক ঘণ্টার জন্যও যানজটের দেখা মেলে না। সিএজি অটোচালকরাও ওসিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। চালকরা বলেন, এখন আর সিএনজি-অটোরিকশার সিরিয়ালের জন্য চাঁদা দিতে হয় না।
আতাইকুলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক উজ্জ্বল হোসেন বলেন, আতাইকুলা থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এত সুন্দর কর্মযজ্ঞ কখনো দেখিনি। থানার বর্তমান কাজ দেখে মনটা ভরে যায়। পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বেড়ে যায়।
আতাইকুলার আবুল হাসেম বলেন, জনপ্রত্যাশা পূরণে এ ওসির ভূমিকা প্রশংসনীয়। আগে থানার ভেতরে ঢুকতে অনুমতি নিতে হতো। অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এখন কোনো ধরনেরহয়রানির শিকার হতে হয় না। সবাই এখন আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।
সদরের কামারডাঙ্গা এলাকার সিরাজ উদ্দিন মাস্টার জানান, আমার এলাকার গরুর মালিকরা সারারাত জেগে তাদের গোয়াল ঘর পাহারা দিত। তারপরও গরু চুরি হতো। ছয় মাস আগে আমার গোয়াল ঘর থেকে একটি বড় গরু চুরি হয়েছে। তার দুই সপ্তাহ পরে আমার পাশের পাড়ায় একজনের গরু অ্যাম্বুলেন্সে করে চুরি হয়েছে। তবে নতুন ওসি আসার পর থেকে আমাদের এলাকায় গরু চুরি হচ্ছে না। গোয়ালঘর পাহারাও দিতে হয় না।
আতাইকুলা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের পরিচালক ও জেলা উদ্যোক্তা ফোরামের সভাপতি মো. শরিফুল ইসলাম খান বলেন, ওসি যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে আতাইকুলা, পুষ্পপাড়া, দুবলিয়া, মাধপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছে। যেটা সন্ত্রাস দমনে ব্যাপক সহায়ক হয়েছে।
আতাইকুলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জালাল উদ্দিন জানান, তিনি আতাইকুলায় এসেই সমস্যার মূলে হাত দেন। এক্ষেত্রে পাবনার পুলিশ সুপার মুহিবুল ইসলাম খানের নির্দেশনা তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার দিকনির্দেশনাগুলো যথাযথ মেনে চলার চেষ্টা করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, তিনি থানা এলাকার বনগ্রাম, দুবলিয়া, আতাইকুলা, পুষ্পপাড়া হাটসহ অন্যান্য ছোট-বড় হাট-বাজারকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় সিসিটিভির আওতায় আনতে পেরেছেন। এতে করে অপরাধমূলক কাজ কমে গেছে। এবারের ঈদেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। গরু চুরি বন্ধ করতে পেরেছেন। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে।
সেবা প্রার্থীদের সকল ধরনের সহযোগিতার জন্য থানার সকল অফিসারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যতদিন এই থানায় আছি জনগণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাব। কোনো অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
পাবনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বলেন, সহকর্মীদের এসব অর্জন দেখে ভালো লাগে। যারা ভালো কাজ করছেন, তাদের আরও বেশি পুরস্কার দেওয়া হবে। যারা অপরাধ করবে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। পুলিশেও এখন ভালো কাজ করার প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এটা একদিকে যেমন দেশ ও জনগণের কল্যাণ হবে তেমনি পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ভালোবাসা বেড়ে যাবে।
রাকিব হাসনাত/এসপি