অসহায়দের চিকিৎসার মাধ্যমে এই চিকিৎসক দম্পত্তি আবারও প্রমাণ করলেন চিকিৎসাই মানবধর্ম

শহরে ছোট একটি মুদি দোকানের মালিক মো. তহিদুল ইসলাম মানিক। কঠোর লকডাউনে বেচাকেনা নেই। লকডাউন শেষেও হাতের অবস্থা ভালো না। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর মধ্যে স্ত্রী তানিয়ার পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়েছে। অস্ত্রোপচার করাবেন, মুদি দোকানি তহিদুলের সেই সামর্থ্যটুকু নেই।

পরে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে গেলে চিকিৎসক ফি, ওটি ও বেড ভাড়াসহ সাকল্য খরচ ৩৫ হাজার টাকা লাগবে বলে জানায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। টাকার অভাবে স্ত্রীর অস্ত্রোপচার করাতে পারছিলেন না। খবর পেয়ে পরে তিনি ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সার্জারি চিকিৎসক ডা. আব্দুল্লাহীল কাফির কাছে ছুটে যান। সব শুনে রোববার (২৯ আগস্ট) দুপুরে সরকারি খরচে তার স্ত্রীকে অস্ত্রোপচার করেন ওই চিকিৎসক। এখন তানিয়া সুস্থ আছেন।

অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনাকালীন চিকিৎসকদের সমন্বয়ে সেবা দিয়ে চলেছেন কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শামীমা শিরীন লুবনা। তার নেতৃত্বে কালীগঞ্জ উপজেলা চিকিৎসক ইউনিট দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। উপজেলার ফয়লা এলাকার রহিমা নামের এক বৃদ্ধা অসুস্থ হলে শরণাপন্ন হন ডা. শামীমা শিরীন লুবনার কাছে। তিনি অসুস্থ বৃদ্ধাকে চিকিৎসাসেবা দেন। বৃদ্ধার কাছে টাকা না থাকায় শামীমা নিজের টাকায় ওষুধ কিনে রোগীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

বলছি মানবিক চিকিৎসক ডা. আব্দুল্লাহীল কাফি ও ডা. শামীমা শিরীন লুবনা দম্পতির কথা। আব্দুল্লাহীল কাফির বাড়ি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার বাটিকামারী গ্রামে। তার বারা নাম মৃত প্রকৌশলী সদর উদ্দিন। আর ডা. শামীমা শিরীনের বাড়ি কালীগঞ্জ পৌর এলাকায়। তার বাবার নাম মৃত আবদুল মান্নান বিশ্বাস।

ডা. আব্দুল্লাহীল কাফি ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সার্জারি জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর তার স্ত্রী ডা. শামীমা শিরীন লুবনা কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে কাজ করছেন।

অসহায়দের চিকিৎসার মাধ্যমে এই চিকিৎসক দম্পত্তি আবারও প্রমাণ করলেন চিকিৎসাই মানবধর্ম। এই চিকিৎসক দম্পত্তি অসহায় ও দুস্থ রোগীদের কাছে মানবতার প্রতীক হিসেবে ইতোমধ্যে মানুষের মন জয় করেছেন।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল থেকে জানা যায়, সদর হাসপাতালের পুরাতন বিল্ডিং থেকে নতুন বিল্ডংয়ে যাওয়ার কারণে সব ধরনের অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) একসঙ্গে চালু করা সম্ভব হয়নি। শুধু গাইনি বিভাগ ও সাধারণ অস্ত্রোপচার (ওটি) বিভাগ চালু করা হয়, কিন্তু পিত্তথলিতে পাথর ও অন্যান্য অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) চালু করা সম্ভব ছিল না।

হাসপাতালের সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্যের নির্দেশে সদর হাসপাতালের সার্জারি জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আব্দুল্লাহীল কাফির প্রচেষ্টায় ১ আগস্ট ঢাকায় স্থানান্তরকৃত এক রোগীর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নতুন ওটি রুম চালু করা হয়। এরপর ৮ আগস্ট প্রথম তানিয়ার পিত্তথলিতে দক্ষতার সঙ্গে অস্ত্রোপচার করেন ডা. আব্দুল্লাহীল কাফি।

তানিয়ার স্বামী মো. তহিদুল ইসলাম মিলন ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি শহরে ছোট একটি মুদি দোকানে ব্যবসা করেন। স্ত্রীর পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়ার পর ঢাকার বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে নিয়ে যান চিকিৎসা করানোর জন্য। সেখানে ৩৫ হাজার টাকা চাওয়অ হয়। কিন্তু তার কাছে এত টাকা না থাকায় ডা. আব্দুল্লাহীল কাফির কাছে সদর হাসপাতালে যান স্ত্রীকে নিয়ে। সবকিছু দেখার পর রোগীর অবস্থা দেখে দ্রুত অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন।

কিন্তু তার কাছে টাকা নেই জানালে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘তোমার স্ত্রীর অপারেশন করতে এত টাকা লাগবে না। আমরা সরকারি খরচেই তোমার স্ত্রীর অপারেশন করিয়ে দেব।’ তহিদুল আরও জানান, শহরে অনেক ডাক্তারকে দেখিয়েছি। কেউ ৩৫-৪০ হাজার টাকার কম অপারেশন করতে চাননি। কিন্তু ডা. আব্দুল্লাহীল কাফি আমার স্ত্রীকে বিনা টাকা অপারেশন করেছেন। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।

তানিয়ার মা রবিউন নাহার জানান, তার মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছেন। কিন্তু কোনো চিকিৎসক টাকা ছাড়া চিকিৎসা করাতে চাননি। এরপর সাংবাদিকদের মাধ্যমে সদর হাসপাতালের ডা. আব্দুল্লাহীল কাফির কথা শোনার পর তার কাছে যান। তিনি বলেন, আজ (রোববার) দুপুরে তানিয়ার অপারেশন হয়েছে। সে এখন সুস্থ আছে। তবে আমাদের মতো এমন অনেক রোগীকে বিনা টাকায় ডা. আব্দুল্লাহীল সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়েছেন। আমরা তার মঙ্গল কামনা করি।

কথা হয় মানবতার সেবক ডা. আব্দুল্লাহীল কাফির সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী ডাক্তারী পেশাকে মানবসেবা হিসেবে নিয়েছি। আর আজ যেটা করেছি, আমি ও আমার এক সহকারী দুজনে মিলে হাসপাতালের খরচে তানিয়ার পিত্তথলিতে পাথর অপারেশন করেছি। রোগী এখন সুস্থ আছে। অসহায় রোগীদের সেবা করাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি।

তিনি আরও বলেন, গত ৮ আগস্টের পর আজ পর্যন্ত ৪ জন পিত্তথলিতে পাথর রোগীকে সরকারি খরচে চিকিৎসা ও অপারেশন করানো হয়েছে। তাদের মধ্যে সবাই অসহায় ও গরিব শ্রেণির রোগী। তাদের দ্বারা সম্ভব নয় বাইরে ক্লিনিকে টাকা খচর করে চিকিৎসা করানো। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আমাদের হাসপাতালের খরচেই তাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছি।

এনএ