সাদিয়া আক্তার রিচি ও রিয়া আক্তার

শাল-গজারি ঘেরা প্রকৃতির স্নিগ্ধ আবেশ মেশানো সবুজ-শ্যামল গ্রাম পানশাইল। গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়ালগড় মির্জাপুর ইউনিয়নের নিভৃত একটি গ্রাম এই পানশাইল। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লবণদহ খালটি গিয়ে মিশেছে তুরাগ নদীতে। তুরাগ-লবণদহ মোহনার কাছেই পরিবার নিয়ে বাস করেন সোলায়মান হোসেন।

স্ত্রী আকলিমা আর দুই কন্যা রিচি ও রিয়াকে নিয়ে সুখেই কাটছিল তার দিন। সুখ-আনন্দে ভরা সোলায়মানের সংসারে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। ছেলে না হওয়ার আক্ষেপ দূর হয়েছিল রিচি-রিয়ার ভালোবাসার কাছে। কিন্তু সোলায়মানের সেই সুখ সহ্য হয়নি পাশেই বয়ে যাওয়া লবণদহ খালটির।

গতকাল সোমবার দুপুরে এই খালই টেনে নিয়েছে বড় মেয়ে রিচি আর ছোট মেয়ে রিয়াকে। আরও ভেসে গেছে প্রতিবেশী হায়েত আলীর মেয়ে আইরিন আক্তার ও মঞ্জুর আলমের মেয়ে মায়া বেগমও। ফায়ার সার্ভিস তাৎক্ষণিকভাবে বড় মেয়ে রিচি, আইরিন ও মায়ার মরদেহ এবং এক দিন পর মঙ্গলবার বিকেলে রিয়ার মরদেহ উদ্ধার করে।

মঙ্গলবার দুপুরে সোলায়মানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোকার্ত পরিবেশ। দুই সন্তান হারিয়ে বাবা-মায়ের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। এ সময় কথা হয় রিচি-রিয়ার বাবা সোলায়মানের সঙ্গে।

রিচি ও রিয়াকে হারিয়ে কাঁদছেন বাবা-মা

সোলায়মান জানান, সাদিয়া আক্তার রিচি ও রিয়া আক্তারের বড় মামা একজন প্রকৌশলী। ছোটবেলা থেকে মামাকে দেখে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন জেঁকে বসে তাদের মনে। গাজীপুর সদর উপজেলার পানশাইল গ্রামের সোলায়মান মিয়া ও আকলিমা আক্তার দম্পতির সন্তান বলতে এ দু’জনই।

এই দম্পতির ছেলে সন্তানের আক্ষেপ থাকলেও দু’বোন তাদের ভালোবাসা দিয়ে বাবা ও মায়ের আক্ষেপ দূর করেছিলেন। মেধাবী দু’বোন লেখাপড়ায় ছিল খুবই মনোযোগী। বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণিতে মেধা তালিকাতেও তারা ছিল প্রথম স্থানে। তাদের নিয়ে বাবা ও মায়েরও ছিল অনেক গর্ব!

অথচ চোখের সামনেই বাড়ির পাশের খালের পানিতে মিশে গেল তাদের প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন। সাথে থমকে গেছে বাবা ও মায়ের স্বপ্নও। সন্তান হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে এখন সামনে শুধুই ভেসে বেড়াচ্ছে তাদের স্মৃতিগুলো।

রিচি হাজী জমির হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। রিয়া শম্পা মডেল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সোমবার দুপুরে বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া লবণদহ খালে গোসল করতে গিয়ে চারজন ডুবে মারা যায়।

Caption

রিয়ার বাবা সোলায়মান মিয়া বলেন, আমি একজন কৃষক। টানাপোড়েনের সংসারে মেয়েদের নিয়েই আমাদের সব স্বপ্ন ছিল। তারা বলত, ‘আমরা দু’বোন প্রকৌশলী হয়ে সংসারে সচ্ছলতা আনব। তোমাদের মুখে হাসি ফোটাব।’ এক দুর্ঘটনা সব শেষ করে দিল... বলেই হুহু করে কেঁদে উঠলেন সোলায়মান।

শম্পা মডেল একাডেমির সহকারী শিক্ষক রেখা আক্তার বলেন, রিয়া খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। এই বয়সেই তার হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। ক্লাসে সে ছিল প্রথম। তাকে নিয়ে বাবা ও মায়ের সঙ্গে আমাদেরও একটি স্বপ্ন ছিল।

রিচির সহপাঠী সুমাইয়া আক্তার বলেন, সে নবম শ্রেণিতে প্রথম ছিল। ঘটনার দিন সকালে আমরা বিদ্যালয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে এসেছি। পথেই বান্ধবীদের সঙ্গে খালে গোসল করতে যাওয়ার কথা হয়। কিছুক্ষণ পরই জানতে পারি তারা পানিতে ভেসে গেছে। পরে তাদের মৃত্যুর খবর শুনতে পাই।

গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ জাকি বলেন, সাঁতার না জানায় তারা এমন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। একজন পানিতে ডুবে গেলে অন্যরা তাকে বাঁচাতে যায়। পরে একে একে চারজনই ডুবে যায়।

শিহাব খান/এমএসআর