গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমিনা খাতুন

গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মনিপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ী এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দেশের অন্যতম বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। ১৯৯৫ সালে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেছেন গিভেন্সী গ্রুপের কর্ণধার খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল। প্রতিষ্ঠানটিতে ঠাঁই হয়েছে ৮০ জন পুরুষ ও ৭০ জন নারীর।

এদেরই একজন আমিনা খাতুন (ছদ্মনাম)। বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের তরা ইউনিয়নে। বাবার ছিল বিঘায় বিঘায় সম্পত্তি। ব্রাহ্মণ ধর্মে দীক্ষিত পাঁচ ভাইয়ের মাঝে সবচেয়ে ছোট বোন হিসেবে আদরের কমতি ছিল না তার। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার বয়স ১০ বছর।

হঠাৎ পাক হানাদারবাহিনী তাদের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে ইন্দারায় (বড় কুয়া) ফেলে ও চার ভাইকে গুলি করে হত্যা করে, আরেক ভাই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াতে প্রাণে বেঁচে যান। স্বজন হারিয়ে তার জায়গা হয় হাফিজ উদ্দিন নামের এক কুরআনের হাফেজের ঘরে। 

মুক্তিযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর বড় ভাই ফিরে আসলেও মুসলিম বাড়িতে পালিত হওয়ায় যুদ্ধ ফেরত ভাই তাকে আর মেনে নেননি। একসময় ভাইও নিখোঁজ হয়ে যান। আর চাচারা সম্পত্তির লোভে ব্রাহ্মণ পরিবারে ফিরিয়ে নেননি তাকে।

একসময় ধর্মান্তরিত আমিনাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ঢাকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করান হাফিজ উদ্দিন। পরে সে ১৯৮১ সালে দাখিল ও পরে আলিম পাস করেন তিনি।

সে বছরেই বদিউল আলম নামের এক মসজিদের ইমামের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ও পাশাপাশি তিনি কোরআনের হাফেজ হন। পরপর তার দুই মেয়ের জন্ম হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর আমিনা তার স্বামীকে হারান।

মৃত্যুশয্যায় স্বামী তার হাত ধরে লেখাপড়া চালিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন। স্বামীর কথামতো তিনি লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে দীর্ঘদিন সরকারের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন শেষে গত বছর অবসরে যান তিনি।

মাত্র নয় বছর বয়স থেকে সংগ্রাম করে আসা এই নারী নিজের উপার্জিত অর্থে দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন। মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বহুতলবিশিষ্ট বাড়িও করেছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জে। সন্তানদের করেছেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত, বিয়েও দিয়েছেন। আলাদা আলাদা বাড়িতে মেয়েরা সুখেই ছিল।

কয়েকবছর পূর্বে হঠাৎ করে তার ছোট মেয়ের স্বামী মারা যান। পরে মেয়ে ও নাতনিদের তিনি তার বাসায় নিয়ে আসেন। নাতনিদের নিয়েই ভালোই কাটছিল অবসরের দিনগুলো। তাদের সঙ্গেই শেষ দিন পর্যন্ত কাটানোর ইচ্ছা ছিল। অথচ অর্থের জন্য তার মেয়েরা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে থাকে।

নিজের সঞ্চয়ের ৫৫ লাখ টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল। তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে এটিএম কার্ড ও পিন নাম্বার নিয়ে কয়েক দফায় পুরো টাকায় উঠিয়ে নেন তার বড় মেয়ে। এতে ছোট মেয়ে প্রতিনিয়তই টাকার জন্য তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকেন। মেয়ের এমন আচরণে দাগ কেটে যার তার মনে। তার প্রতিটি কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়ান তার ছোট মেয়ে।

একদিন খাবারের সময় হলে ধাক্কা দিয়ে তার সামনে খাবারের প্লেট দেন মেয়ে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি তিনি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে যায় তার। আত্মহত্যারও সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু এ ঘরে যে বাস করে তার মেয়ে নাতি-নাতনি। তারা ভয় পাবে, আর হয়তো এ ঘরে বাস করবেন না, তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি।

তাই গত মার্চ মাসের একরাতে বাসার মূলফটকের চাবি নিয়ে নেন নিজের কাছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে সবার অগোচরে খুব ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে গেটের চাবি ছুড়ে আসেন। বন্ধ করে দেন ব্যবহৃত মুঠোফোন। চলে আসেন গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে। যেখানে শত আশ্রিতের সঙ্গে স্বজনহীন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা তিনি।

সংগ্রামী এ নারী জানান, তার জীবনলিপি হয়তো সৃষ্টিকর্তা ভিন্নভাবেই লিপিবদ্ধ করেছেন। বাঁকে বাঁকে মোড় নিয়েছে অতিবাহিত হওয়া সময়গুলো। কত কষ্ট করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সন্তানদের মানুষ করেছেন। অথচ জীবনের শেষ সময়ে তাদের দুর্ব্যবহার মেনে নিতে পারি না। অর্থের জন্য নিজের মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ কি ভুলা যায়? তাই তাদের সুখের কথা বিবেচনা করেই তাদের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি। অন্তত তারা যেন ভালো থাকে। মৃত্যু পর্যন্ত এমন আশীর্বাদ থাকবে তাদের জন্য।

গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মনিপুর এলাকায় গিভেন্সী গ্রুপের কর্ণধার খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসহায় প্রবীণদের জীবনের শেষ ঠিকানা ‌‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৮০ জন পুরুষ ও ৭০ জন নারী রয়েছেন। যাদের অনেকেরই সন্তান দেশের বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের অনেকেই সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি। সন্তান অনেক সময় তার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবজ্ঞা করছেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন। তেমনি অনেক অসহায় বাবা ও মা শেষ জীবনে এখানে কাটাচ্ছেন। তাদের সবার জীবনের গল্পটা কষ্টের। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা থাকবে কোনো বাবা ও মায়ের স্থান যেন বৃদ্ধাশ্রমে না হয়।

এমএসআর