কেউ সাবেক ইউপি সদস্য, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ কৃষক; আবার কেউ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। বর্তমানে তাদের সবার একটাই পরিচয়, তারা প্রবীণ। তাদের সবার বয়স ৬০-৭০ বছরের ওপরে। জীবনের শেষ সময়ে এসে শুয়ে-বসে কিংবা ইবাদত বন্দেগি করে কাটানোর কথা থাকলেও তারা প্রবীণদের মর্যাদা রক্ষাসহ চালিয়ে যাচ্ছেন নানা দৃষ্টান্তমূলক কাজ। তাদের এসব কাজ দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন এলাকার তরুণ সমাজও।

বলছি হাওরদ্বীপ হিসেবে পরিচিত নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার ‘বৃদ্ধ বন্ধু সমিতি’র কথা। ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন খালিয়াজুরী গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য রহমত আলী তালুকদার। তার প্রচেষ্টায় এলাকার ৬০ জন প্রবীণকে নিয়ে গঠন করা হয় বৃদ্ধ বন্ধু সমিতি। বর্তমানে এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৫৩ জন। সাতজন সদস্য ইতোমধ্যে মারা গেছেন। প্রয়াত বৃদ্ধদের সন্তানদের ‘প্রজন্ম সদস্য’ করার উদ্যোগ নিয়েছেন সমিতির সদস্যরা।

প্রবীণদের জীবনমানের উন্নয়ন, মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তারা নিজেরাই সমিতির অর্থের যোগান দিচ্ছেন। আবার সেই অর্থ ব্যয় করছেন অসহায় প্রবীণদের জন্য। কেউ মারা গেলে সৎকারসহ তার পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করছেন। আবার অসুস্থ প্রবীণদের দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা সহায়তা, অসহায় শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে আর্থিক সহায়তা এবং প্রতি বছর নিজেদের জন্য আয়োজন করছেন চিত্তবিনোদনের নানা অনুষ্ঠান। বৃদ্ধ বন্ধু সমিতির সদস্যরা সবাই জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হলেও তারা নিজেদের যুবক ভেবে এসব কাজ করে যাচ্ছেন। কাজ করে যাচ্ছেন সমাজের মঙ্গলের জন্য। 

বৃদ্ধ বন্ধু সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মো. রহমত আলী তালুকদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক গল্প করেন। তিনি বলেন, আমরা কারো সহযোগিতা ছাড়াই প্রতি বছর আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন করি। এখানে হাসি-খুশি, ভাব-বিনিময়, কোলাকুলি, গান বাজনা ও স্মৃতিচারণে সৃষ্টি হয় এক আনন্দঘন মিলনমেলা। 

তিনি আরও বলেন, প্রবীণরা মৌলিক অধিকার থেকে প্রায়ই উপেক্ষিত থাকেন। সরকারি-বেসরকারি দফতরেও আমাদের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই। গানবাজনা, পিকনিক, আনন্দ-উল্লাস এসব সমাজের অন্য বয়সীরা ইতিবাচকভাবে নেয় না। সমাজ আমাদের পোশাক নির্ধারণ করে দিয়েছে। সাদা পাঞ্জাবি, গ্রামীণ চেক লুঙ্গি বা পায়জামা আমাদের জন্য নির্ধারিত। 

অন্য বয়সীরা মনে করেন, প্রবীণ ব্যক্তি মানেই অসুস্থ সহায়হীন; বৃদ্ধ মানেই মসজিদ-মন্দির আর ঘরের কোণে বসে থাকতে হবে। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭৫ বছর বয়সেও অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছেন। নেত্রকোনা-৪ (মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরী) আসনের সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন, ড. মোহাম্মদ ইউনূস ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মতো ব্যক্তিরা যদি বয়স বৈষম্যের শিকার হয়ে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতেন, তাহলে হয়তো এদেশ অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতো।

আমার ইচ্ছা, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রবীণদের খেলাধুলার জন্য একটি ক্লাব ঘর ও একটি চায়ের স্টল করার। আমি লক্ষ্য করেছি, আমরা (বৃদ্ধরা) কোনো চায়ের দোকানে চা খেতে গেলে দোকানিরা বিরক্তি বোধ করেন, তাদের ধারণা আমরা বসলে দোকানে কাস্টমার কম আসে, তাই আমাদের জন্য আলাদা চায়ের দোকান করব ইনশাআল্লাহ।

তবে বৃদ্ধ বন্ধু সমিতির নিজস্ব কোনো কার্যালয় না থাকায় সংগঠনটির কার্যক্রম চালাতে অনেক অসুবিধা হচ্ছে জানিয়ে কোষাধ্যক্ষ রঞ্জিত সরকার বলেন, আমাদের একটা নিজস্ব ঘর খুবই জরুরি। আর এ জন্য তিনি সরকারি সহযোগিতা চেয়েছেন।

তিনি বলেন, সদস্যরা প্রতি মাসে ২৫ টাকা করে চাঁদা দেয়। এ ছাড়া বিত্তশালীদের অনুদানের টাকা মিলে বর্তমানে আমাদের তহবিলে ২ লাখ টাকার বেশি রয়েছে। এ টাকা দিয়ে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

স্থানীয় কলেজছাত্র জুনাঈদ মিয়া বলেন, বৃদ্ধ বন্ধু সমিতি যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে, অনেক তরুণের পক্ষে তা করা সম্ভব হয় না। সাধারণত তরুণ বয়সে মানুষ নানা রকম ক্লাব ও সংগঠন করে, বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে। কিন্তু ৭০-৮০ বছরের একদল বৃদ্ধ মিলে বৃদ্ধ বন্ধু সমিতির মাধ্যমে যেসব কার্যক্রম করছেন তা সত্যিই দারুণ এবং এ থেকে তরুণদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের বাসিন্দা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বৃদ্ধ বন্ধু সমিতি যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে তা সারা দেশের জন্য দৃষ্টান্ত বলে আমি মনে করি। তাই বৃদ্ধ বন্ধু সমিতিকে সহযোগিতা করতে সবার এগিয়ে আসা উচিত। বিশেষ করে সংগঠনটির জন্য একটা ঘর করে দেওয়া দরকার।

এসপি/জেএস