ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাগেরহাটের ৯ উপজেলায় আশঙ্কাজনকহারে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বেশি বিয়ে হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল ও মাদরাসা খোলার পর থেকে ধীরে ধীরে সামনে আসতে থাকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহের বিষয়টি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিচ্ছেদও বেড়েছে জেলায়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী করোনাকালে বাগেরহাটে ৩ হাজার ১৭৮ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে ২০২০ সালে এক বছরে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ২ হাজার ৭৯৯টি। 

এতো সংখ্যক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য মহিলাবিষয়ক অধিদফতর ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন কাজ করে। এর সঙ্গে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, নারী সংগঠন, জেলা মহিলা সংস্থা, মহিলা পরিষদসহ নানা সংগঠন রয়েছে। তারা এ সময়ে কী করেছেন? বাল্যবিবাহ বন্ধ ও পারিবারিক কলহ কমাতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছেন তারা।

বাগেরহাট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, করোনা শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে চলতি বছরের ১২ সেপ্টম্বর পর্যন্ত বাগেরহাট জেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ৫২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ১৭৮ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে কচুয়া উপজেলায় সব থেকে বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এই উপজেলায় ৫১৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এর পরেই রয়েছে বাগেরহাট সদর উপজেলার অবস্থান। এই উপজেলায় ৪৯৭টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। 

চিতলমারীতে ৪০৭, ফকিরহাটে ৩৯১, মোল্লাহাটে ৩৪৪, মোরেলগঞ্জে ৩৫৫, রামপালে ২৩৭, মোংলায় ২১৮ এবং শরণখোলায় ২১৩টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এর বাইরে জেলার ৩৪টি স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের অপ্রাপ্ত বয়স্ক বেশ কিছু শিক্ষার্থীরও বাল্যবিবাহ হয়েছে। ঝরে পড়া ও বিদ্যালয়ে না যাওয়া হতদরিদ্র পরিবারের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ে হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে ঠিক কী পরিমাণ বাল্যবিবাহ হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কোনো দফতরের কাছে নেই।

বাগেরহাট জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৭৩৯টি বিবাহ হয়েছে। অন্যদিকে ২ হাজার ৭৯৯টি তালাক সংগঠিত হয়েছে এই সময়ে। নিকাহ রেজিস্ট্রারদের মাধ্যমে সংগঠিত সকল বিবাহে সরকার নির্ধারিত বয়স মানা হয়েছে বলে দাবি বাগেরহাট জেলা রেজিস্ট্রারের।

এদিকে ১০ দিনেও করোনাকালে কী পরিমাণ বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে সেই তথ্য দিতে পারেনি জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতর। অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনোয়ারা খানম কয়েকবার এই তথ্য দেওয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তিনি তথ্য দেননি। বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে মুঠোফোনে তথ্য দেওয়ার কথা বললেও পরে ফোনটি বন্ধ করে রাখেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে বাল্যবিবাহের শিকার কচুয়া উপজেলার এক ছাত্রী জানায়, করোনার সময় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল। সেই সময় এক ঘটক বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। বাবাও রাজি হয়ে যায়। এখন আমি স্কুলেও যেতে পারি না, পড়ালেখাও করতে পারি না। 

বাগেরহাট পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও নারী নেত্রী তানিয়া খাতুন বলেন, করোনাকালে দরিদ্র ও বস্তিবাসীদের মধ্যে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য সচেতনতামূলক কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। যার ফলে বাল্যবিবাহ আরও বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসীকে সচেতন করতে পারলে বাল্যবিবাহ কমবে বলে মনে করেন তিনি।

বাগেরহাট মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ও নারী অধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট শরিফা খানম জানান, করোনাকালে সব কিছু এক ধরনের স্থবির হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। এছাড়া মুঠোফোনে  অতিরিক্ত আসক্তি, সচেতনতার অভাব ও দারিদ্রের কারণে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালে এটা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এটা নিয়ে এখন নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। 

বাগেরহাট মহিলা পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট সীতা রাণী দেবনাথ বলেন, মহিলা পরিষদ বাল্যবিবাহ বন্ধসহ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। করোনাকালে যে পরিমাণ বাল্যবিবাহের কথা আমরা জানতে পেরেছি এটি খুবই উদ্বেগের। বাল্যবিবাহ রোধে আরও বেশি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বাল্যবিবাহের কুফলগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার। 

বাগেরহাট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজিরাসহ শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে করোনাকালে বাল্যবিবাহের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। শিক্ষকদের তথ্য অনুযায়ী জেলায় ৫২২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ১৭৮ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন। ভবিষ্যতে বাল্যবিবাহ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি।  

বাগেরহাট জেলা রেজিস্ট্রার মনিরুল হাসান বলেন, যারা রেজিস্ট্রার কাজি রয়েছেন তারা বিয়ে পড়ানোর আগে বয়স প্রমাণের বৈধ কাগজপত্র দেখে বিয়ে পড়ান। নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজিদের বাল্যবিবাহ নিবন্ধনের কোনো সুযোগ নেই। এরপরও যদি কোনো কাজি অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বা অবহেলা করে বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করেন সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বাল্যবিবাহ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি। যেখানেই তারা বাল্যবিবাহের খবর পাবেন সেখানে তাৎক্ষণিক গিয়ে বিয়ে বন্ধ করবেন। এছাড়া নিকাহ রেজিস্ট্রার ও স্থানীয় ইমামদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যদি কোনো নিকাহ রেজিস্ট্রার বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত থাকেন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

তানজীম আহমেদ/আরএআর