কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে তিন দিনব্যাপী ৫০০ বছরের পুরোনো ঢাক-ঢোলের হাট শুরু হয়েছে। রোববার (১০ অক্টোবর) সকাল থেকে বিভিন্ন জেলার ঢাকিরা হাটে আসতে শুরু করেছেন।

জানা গেছে, ঢাকিরা অর্থের বিনিময়ে পূজার আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। পরে তারা বাদ্যের তালে তালে মাতিয়ে রাখেন মণ্ডপগুলো। কোন দলের চুক্তি মূল্য কত হবে, তা নির্ধারণ হয় ঢাকিদের দক্ষতার ওপর। তাই হাটেই দক্ষতা যাচাই করে দলগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় আয়োজকরা।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাটে হাজির হয়েছেন অসংখ্য বাদক। সাধারণত তাদের সঙ্গে দলগতভাবে চুক্তি হয়। সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায় তাদের চুক্তি মূল্য। ঢাকিরা বংশ পরম্পরায় প্রতি বছরই এ হাটে ঢাক-ঢোল নিয়ে উপস্থিত হয়।

জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান।

সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকির দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নিতেন এবং পুরস্কৃত করতেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু হয়। পরে এ হাট স্থানান্তর করে কটিয়াদীর পুরাতন বাজারের মাছ মহাল এলাকায় আনা হয়।

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকের বায়না করতে এসেছেন সুকুমার সাহা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছরই ঢাকের হাটে আসা হয়। শুধু এখান থেকেই পছন্দমতো ঢাকি পাওয়া যায়। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকিরা আসেন। তাদের মনোমুগ্ধকর বাজনা শুনে পছন্দমতো কাউকে বেছে নেই। গত বছরও এখান থেকে ২০ হাজার টাকায় বায়না করেছিলাম। এবার একটি দলকে পছন্দ করে বায়না করে নিয়ে যাব।

নরসিংদী থেকে এসেছেন সানাই বাদক রঞ্জন দাস। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছর কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাটে আমরা আসি। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঢাক বাজাতে চলে যাই। গত বছর পাঁচ দিনের চুক্তিতে সিলেটের একটি পূজামণ্ডপে গিয়েছিলাম। এ বছরও বিভিন্ন জায়গার লোকজনের সঙ্গে কথা চলছে।

বিক্রমপুর থেকে আসা ঢাকি সানো কুমার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাপ-দাদারা এই হাটে আসতেন। ২০ বছর ধরে আমিও এই ঢাকের হাটে আসি। প্রত্যেকবারই বায়না হয়ে যায়।

কটিয়াদী ঢাকের হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বেনি মাদব ঘোষ বলেন, ইতোমধ্যে ১৩৩টি ঢাকি দল চুক্তিবদ্ধ হয়ে হাট ছেড়েছে। সর্বোচ্চ এক লাখ এবং সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকায় ঢাকিরা মণ্ডপে গেছেন। তবে কিছু ঢাকির জন্য মণ্ডপ মিলবে না। তাঁদের খাওয়া-দাওয়া ও যাতায়াতের খরচ ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।

কটিয়াদী পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনশ্রুতি আছে এ মেলার ইতিহাস অন্তত পাঁচশো পছরের পুরোনো। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার প্রাসাদে পূজার আয়োজনের জন্য সেরা ঢাকির খোঁজ করতে গিয়ে বিক্রমপুর পরগনার প্রসিদ্ধ সব ঢাকিকে আমন্ত্রণ জানান। তারপর সবার বাজনা শুনে বেছে নেন সেরা দলটিকে। সেই সময় থেকে ঢাক-ঢোলের হাটের শুরু।

দিলীপ কুমার সাহা বলেন, এ হাটে ঘুরে ঘুরে বাদকদের বাজনা পরখ করে দেখেন পূজার আয়োজনকারীরা। ঢাকিদের বাজনা পছন্দ হলে আর দরদামে মিলে গেলে বায়না করে নিয়ে যায় তারা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জ্যোতিশ্বর পাল ঢাকা পোস্টকে জানান, পূজার আয়োজক ও বাদকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য কটিয়াদী মডেল থানা পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদারকি করা হচ্ছে।

এসপি