দেশীয় পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাময় একটি জেলা বাগেরহাট। দেশের ৩টি বিশ্ব ঐতিহ্যের দুটিই বাগেরহাটে। একদিকে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য অপরদিকে ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ। পর্যটন শিল্পে এ জেলার অপার সম্ভবনা থাকলেও দীর্ঘদিনেও নিশ্চিত করা যায়নি প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা।

এছাড়াও মানসম্মত খাবার হোটেল-আবাসন ব্যবস্থারও রয়েছে সংকট। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে নেই ট্যুরিস্ট গাইড। সুন্দরবনের যাতায়াত ব্যবস্থাও নাজুক। সবকিছু মিলিয়ে নানা সংকটে দিন দিন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় এ জেলার পর্যটন শিল্প। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন সুন্দরবন ও ষাট গম্বুজ মসজিদসহ জেলাকে পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ।

ষোড়শ শতাব্দীতে খানজাহান আমলে নির্মিত ইসলামি স্থাপত্য রীতির মসজিদগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৮৫ সালে বাগেরহাটকে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি ৩২১তম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো। এরমধ্যে বাগেরহাটের ১৭টি স্থাপনাকেও বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়।

তালিকাভুক্ত স্থাপনাসমূহ হচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাট গম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগুনি মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, দশ গম্বুজ মসজিদ, রণ বিজয়পুর মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ, খান জাহান আলী (রহ.) এর সমাধি, এক গম্বুজ মসজিদ, পীর আলী তাহেরের সমাধি, জিন্দা পীরের মসজিদ, জিন্দা পীরের সমাধি, সাবেক ডাঙ্গা প্রার্থনা কক্ষ, দশ গম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলী (রহ.)-এর বসতভিটা, বড় আদিনা ডিবি, খান জাহানের তৈরি প্রাচীন রাস্তা।

তবে তালিকাভুক্ত এসব স্থাপনার মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ ছাড়া অন্যান্য স্থাপনাগুলো পড়ে রয়েছে অযত্ন আর অবহেলায়। স্থাপনাগুলোকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হলে বাগেরহাটের পর্যটন শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

ঢাকা থেকে আসা জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ষাট গম্বুজ মসজিদ সম্পর্কে আগে বইতে পড়েছি। এবার স্বচক্ষে দেখে আমি অভিভূত। বাংলাদেশে এত সুন্দর একটি মসজিদ আছে না দেখলে বুঝতাম না। তবে অবস্থান করার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় আরও অনেক নিদর্শনই দেখার সুযোগ হয়নি। বাধ্য হয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে।

নয় গম্বুজ মসজিদ প্রাঙ্গণে কথা হয় খুলনা থেকে আসা ত্বহা, আমিনুল ও খালিদের সাথে। তারা বলেন, প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাগেরহাটে আমরা ঘুরতে এসেছি। সকাল থেকে বেশ কয়েকটি স্থাপনা ঘুরেছি। কিন্তু একমাত্র ষাট গম্বুজ মসজিদ ছাড়া অন্য স্থাপনাগুলোতে না আছে নিরাপত্তা, না আছে সংরক্ষণের উদ্যোগ। স্থাপনা প্রাঙ্গনে গরু-ছাগল চরছে। স্থানীয়রা কাপড় শুকাচ্ছে। পরিবেশ একটুও দর্শনার্থীবান্ধব নয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাছে এসব প্রাচীন নিদর্শন সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।

সাতক্ষীরা থেকে বাগেরহাটে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী ফাহিম ফয়সালের সাথে কথা হয় প্রাচীন রেজা খোদা মসজিদের সামনে। কথার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ষাট গম্বুজ ও খান জাহান আলীর মাজার ঘুরে অন্য নিদর্শন দেখতে অনেকক্ষণ ঘুরছি। অনেক কষ্টে এ মসজিদ পর্যন্ত এসেছি। কিন্তু মসজিদের ভগ্নদশা দেখে খুবই হতাশ। শুনেছি অন্যান্য নিদর্শনগুলোর অবস্থাও এমন। আশা করি এসব ঐতিহ্য রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
 
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন নষ্ট হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। আমরা চাইলেও সংস্কার করতে পারি না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কিছু করেনা আমাদেরও করতে দেয় না। রাজস্ব আয়ের এত এত টাকা দিয়ে কী করেন তা বুঝি না।

স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনসাধারণকেও পর্যটকদের প্রতি সহযোগিতামূলক আচরণে উদ্যোগী হতে হবে। অনেক সময় দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকরা স্থানীয়দের কাছ থেকে আশানুরূপ ভালো আচরণ পান না। এ বিষয়ে পর্যটন এলাকার মানুষদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
 
ষাট গম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, পদ্মার এপারে তিনটি বিখ্যাত জায়গার মধ্যে দুটো বাগেরহাটে। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের থাকার কন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দীর্ঘদিনের দাবি ও এলাকার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটন করপোরেশন বাগেরহাটে একটি মোটেল নির্মাণ করছে, যা এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।


 
বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন বলেন, বাগেরহাটের প্রবেশপথে যদি ব্যানার বা বিলবোর্ডের মাধ্যমে একনজরে বাগেরহাটের দর্শনীয় স্থাপনার বর্ণনা, যাতায়াত ব্যবস্থা, খাবার ও থাকার হোটেল সম্পর্কে লিখে রাখা যায় তবে দর্শনার্থীদের ভ্রমণ আরও সহজতর হবে।

বাগেরহাট প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ জানান, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে স্থানীয়ভাবে দর্শনার্থীদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে যেমন দর্শনার্থী সংখ্যা বাড়বে তেমনই রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ষাট গম্বুজের সামনে বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মসজিদ সংলগ্ন ঘোড়াদিঘিকে নান্দনিক করতে ওয়াকওয়ে করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ষাট গম্বুজ মসজিদ দেখতে এসেছেন ৯০ জন বিদেশিসহ ২ লাখ ৪১ হাজার ৫৪৫ জন দর্শনার্থী। এ সময়ে রাজস্ব আয় হয় ৩৯ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার মধ্যেও ষাটগম্বুজ দেখতে এসেছেন প্রায় ৯ হাজার দর্শনার্থী।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগীয় কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন জানান, করোনাকালীন ২০২০-২১ অর্থ বছরে সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি প্রায় ৯ হাজার দর্শনার্থী এসেছেন। এ সময়ে রাজস্ব আয় হয়েছে ৬৭ লাখ ৭ হাজার ৪৭৬ টাকা। পাশাপাশি সুন্দরবনকে আরও পর্যটনবান্ধব করতে সুন্দরবনের আলীবান্ধা ও আন্ধারমানিকে দুটি পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

জেলা প্রশাসক (ডিসি) আজিজুর রহমান বলেন, বাগেরহাটকে পর্যটনবান্ধব করতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রত্যেকটি পর্যটন কেন্দ্রের শোভাবর্ধন, আবাসন ব্যবস্থা, মানসম্মত খাবার, বিপনন কেন্দ্র, সহজ যাতায়াত, সার্বিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। অচিরেই বাগেরহাটের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে।
 
তানজীম আহমেদ/আরআই