৮০০ বিঘা জমির ওপর এক স্বর্গীয় বাগান গড়ে তুলেছেন মো. হযরত আলী। যেখানে শোভা পাচ্ছে প্রায় ৫২ হাজার গাছের চারা। তার মধ্যে ২৫০ প্রজাতির ফলদ গাছ। গত দুই বছরে সেসব গাছ থেকে বিক্রি করেছেন ১০ কোটি টাকার ফল। মানুষকে কীভাবে বিষমুক্ত ফল খাওয়ানো যায়, সেই চিন্তা থেকেই হযরত গড়ে তোলেন ‘মেসার্স মা-বাবার দোয়া ফ্রুট গার্ডেন নার্সারি অ্যান্ড এগ্রোফার্ম’ নামের বাগান।

হযরত আলীর বাগানে ১৯ হাজারের মতো রয়েছে মাল্টা গাছ। অন্য গাছের মধ্যে কমলা, আঙুর, পেয়ারা, পেঁপে, খেঁজুর, লেবু, ডরিমন, আম, ত্বীন ফল, লিচু, ড্রাগন, শরিফা, সফেদাসহ ২৫০টির মতো ফলদ গাছ। এর পাশাপাশি তিনি গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি, কবুতর ও মাছ চাষ করেন।

মো. হযরত আলী সদর উপজেলার কুঠুরাকান্দা গ্রামের হাজী ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় হযরত আলী। একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তার পাশাপাশি তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আটা, ময়দা, তেল ইত্যাদির ব্যবসা করেন। সেখানেও তার শতাধিক কর্মী রয়েছেন।

আবেগআপ্লুত হয়ে হযরত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তখনকার সময়ে (২০০১ সাল) স্থানীয় কৃষকরা গমের বীজ রোপণের পর সেটি পাখি, কবুতর থেকে রক্ষার জন্য পাহাদার হিসেবে ছোট ছেলেদের রাখতেন। বিনিময়ে দিতেন দু-এক বেলা খাবার। অভাবের সংসার ও ক্ষুধার জ্বালায় তখন কৃষকের গমক্ষেত পাহারা দিতাম আমি। সেটার জন্য তারা আমাকে খাবার দিতেন।

হযরত আরও বলেন, তখন আমার কাছে ভাত মানে অনেক কিছু। আমাদের এমনও সময় গেছে অল্প পানি ভাত ৩ ভাই মিলে খেয়েছি। মা বাবা খাওয়ার অভিনয় করে, না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন।

হযরত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ৮০০ বিঘা জমি কিছু নিজের, কিছু লিজ নেওয়া। এ জমিতে আমার ৫২ হাজারের মতো চারা আছে। এর মধ্যে ২৫০ প্রজাতির ফলদ চারা আছে। এ পর্যন্ত এই বাগান থেকে আমি ১০ কোটি টাকার ফল বিক্রি করেছি। এর পাশাপাশি আমার রয়েছে গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি, কবুতর ও মাছ চাষ।

বাগানের ফল বিক্রি করে কত টাকা আয় হয়, এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে আমরা বার্ষিক হিসাব করে রাখি। তবে ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২১ সাল পর্যন্ত এসেছি। এ পর্যন্ত আমি ১০ কোটি টাকার মতো বিক্রি করেছি। সব খরচ বাদ দিলে আমার আয় ভালোই হবে। তবে সামনের দিকে বোঝা যাবে মাসিক আয় কত আসে।

তিনি বলেন, প্রতিদিনই অনেকেই আমার ফল-বাগান দেখতে আসেন। তারা খুশি হন, ফল কেনেন, আবার কেউ কেউ ফল-বাগান করার সহায়তা চান। আমরা জেলায় বিভিন্ন জনকে ছাদ-বাগান করে দিয়েছি।

হযরত আলী বলেন, আমি খ্যাতিমান সাংবাদিক শাইখ সিরাজের খুব ভক্ত। তার করা প্রতিটি কৃষি প্রতিবেদন আমি দেখতাম। এ পর্যন্ত আমি ৫২টি জেলায় কৃষি উদ্যোক্তাদের বাগান দেখতে গিয়েছি। সেটারই ধারাবাহিকতায় আজ শেরপুর জেলায় ৮০০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের ফলজ বাগান করেছি। নাম দিয়েছি ‘মা-বাবার দোয়া ফ্রুট গার্ডেন’। শাইখ সিরাজ আমার বাগানে এসেছিলেন। তিনি আমাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন।

২০০১ সালে বড় মামার সঙ্গে ঢাকায় এসে একটি মুদি দোকানে চাকরি নেই। এরপর ২০০৬ সালে সেই দোকান বন্ধ হয়ে গেলে আমি আবারও বেকার হয়ে পড়ি। তখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। কখনো ফেরি করে ফলমূল বিক্রি করতাম। এরপর আবার গার্মেন্টসে কাজ করেছি। পরে পাইকারি ব্যবসা শুরু করি। মা-বাবার দোয়ায় আজ ২০২১ সালে আমি কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় যায় বলে জানান তিনি।

মা-বাবার দোয়া ফ্রুট গার্ডেনের প্রজেক্ট ইনচার্জ আবু সাঈদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই বাগানে মাল্টাসহ অন্য ফল কীটনাশক ও ফরমালিনমুক্ত। তাই এসব ফলের চাহিদা বেশি। এ বছর ১৪ কোটি টাকার ফল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে এরই মধ্যে ১০ কোটি টাকার ফল বিক্রি করা হয়েছে। আমরা ব্যবসার পাশাপাশি চিন্তা করি দেশের মানুষকে কীভাবে বিষমুক্ত ফল খাওয়ানো যায়। সে চিন্তা থেকেই বাগানের মালিক হযরত আলী ২০১৯ সালে শেরপুরে ৮০০ বিঘা জমি নিয়ে বড় ফলের বাগান করেন।

বাগান কর্মী সোহাগ মিয়া বলেন, হযরত আলী অনেক ভালো মনের মানুষ। তার সব প্রজেক্টে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বিশাল এই বাগানের প্রায় ১০০ জন শ্রমিক শিফট করে দেখাশোনা করি। তিনি আমাকে প্রতি মাসে ১৮ হাজার টাকা বেতন দেন। যা দিয়ে খুব সচ্ছলভাবে আমার সংসার চলে।

বাগানে ঘুরতে আসা যুবক সুজন মিয়া বলেন, হযরত আলীর এত বড় প্রজেক্টের কথা অনেকের মুখে শুনেছি। তাই আজ দেখতে এলাম। এত সুন্দর সবুজের সমারোহ সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো। হযরত আলী ফলজ বৃক্ষের পাশাপাশি গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি, কবুতর, মাছ চাষ করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। যাকে অনুসরণ করে হাজারো বেকার উৎসাহিত হবেন।

স্থানীয় কৃষক হবিবুর রহমান বলেন, আমি হযরত আলীর বাগানের সফলতা দেখে নিজের ১০ কাঠা জমিতে মাল্টার চাষ করেছি। আমার মাল্টার বাগান অনেক ভালো হয়েছে। আশা করছি মাল্টা বিক্রি করে লাভবান হতে পারব।

রৌহা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মিজু বলেন, আমাদের এলাকায় এত বড় একটি কৃষি-বাগান রয়েছে, সেটি অত্যন্ত গর্বের। হযরত আলীর বাগানে কাজ করে অনেক বেকার মানুষের অভাব দূর হয়েছে। আশা করি তাকে দেখে স্থানীয় অনেক যুবক উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।

শেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুবাইয়া ইয়াসমিন বলেন, শেরপুরের কৃষকরা একসময় ধান আর পাট ছাড়া অন্য কিছু চাষাবাদ করতেন না। এখন ফসলের পাশাপাশি তারা ফলের চাষও শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে হযরত আলী একজন সফল উদ্যোক্তা। সদর উপজেলা কৃষি অফিস তার সাফল্যে গর্বিত। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে নানাভাবে পরামর্শসহ সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।

এনএ