ভারতের উজান থেকে আসা পানিতে তিস্তা নদী এখন টইটম্বুর। নদী তীরবর্তী গঙ্গাচড়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, আবাদি জমিসহ ধান, আলু, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলের খেত। পানির কমার সঙ্গে এখন দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। ঝুঁকিতে রয়েছে নিম্নাঞ্চলে সড়কপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা।

জেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত গঙ্গাচড়ায় সৃষ্ট এ বন্যায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন কৃষকেরা। কার্তিকে পানিশূন্যে তিস্তার বুকে শীতকালীন শাকসবজি ছাড়াও বাদাম, আগাম আলু, মিষ্টি কুমড়া, ধান ও অন্যান্য ফসল বুনেছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ ভারতের উজান থেকে ভাটিতে আসা পানিতে সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেছে। নদী তীরবর্তী গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) সকাল থেকে তিস্তায় পানি কমতে শুরু হয়েছে। তবে পানির কমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ। দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য বেড়েছে আহাজারি। বর্তমানে গঙ্গাচড়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রংপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, দেশের উজানে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, জলপাইগুড়িতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখান থেকে ভাটির দিকে আসা পানিতে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তিস্তা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি (জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে তিস্তাপারে সৃষ্ট বন্যার পানিতে এখনো অনেক এলাকা পানিবন্দি হয়ে আছে। ভাঙন তীব্র হওয়াতে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছগাছালিসহ বসতভিটা। পানিবন্দি এলাকায় অনেকই গবাদিপশু ও ঘরের আসবাব নিয়ে রাস্তায় ও উঁচু স্থানে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন।

কেউবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় ভাসছেন। আবার কেউ কেউ পরিচিত অপরিচিতজনের বসতবাড়িতে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছেন। গঙ্গাচড়ার আলমবিদিতর, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা, কোলকোন্দ, নোহালী ও মর্ণেয়া ইউনিয়নের অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, পানি কমে গেলেও বিভিন্ন ফসলের খেতগুলো এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। স্থানীয় কৃষকেরা জানায়, কিছু খেত থেকে পানি সরে গেলেও এসব খেতে ফসল আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। পানি সরে যাওয়ার পরে ফসলে পচন দেখা দিতে পারে।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়েনের কেল্লারহাট গ্রামের কৃষক নাছিমুুদ্দী বকস বলেন, ‘হামার আবাদি জমি সোগ তলে গেইচে। এ্যালা তিস্তার পানিত ধান, আলু, শাকসবজি সোগ ডুবি আছে। হঠাৎ এদোন করি ভারত পানি ছাড়লে হামরা বাঁচমো ক্যামন করি? একে তো গেল বানোত (বন্যা) হামার মেলা ক্ষয়ক্ষতি হইছে। তার ওপর এই অসময়ে ফির বান! নদী পাড়োত হামার সুখ-শান্তি নাই।’

শংকরদহ গ্রামের কৃষক জয়নাল মিয়া বলেন, ‌‌‘মহিপুর সেতুর কাছে চরোত একনা আগাম আলু আর মিষ্টিকুমড়া নাগাচু (চাষাবাদ করা)। শীতের সময় নয়া আলুর দাম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ তিস্তাত পানি বাড়ছে। হু হু করি পানি ঢুকি আবাদসুবাদ সোগে তলে গেইচে।’

লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল হাদী বলেন, অনেক এলাকায় এখনো মানুষজন পানিবন্দি রয়েছে। ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি মানুষকে সহায়তা করার জন্য কিছু শুকনা খাবার ও চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, উত্তর চিলাখাল, সাউথপাড়া, মটুকপুরসহ চার গ্রামের ফসলও পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে জানান সেখানকার চেয়ারম্যান সোহরাব আলী। এছাড়া গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, মহিষাসুর, রমাকান্ত, আলালচর, জয়দেব এলাকা, নোহালী, আলমবিদিতর, গজঘণ্টা, গঙ্গাচড়া সদর ও মর্নেয়ার নিম্নাঞ্চল ফসলেরও একই অবস্থা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার তিস্তাবেষ্টিত নিম্নাঞ্চল ও নদীর বুকে জেগে ওঠা চর এলাকায় এবার ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। এর পুরোটাই আকস্মিক এ বন্যায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ২৪ হেক্টর জমিতে আগাম জাতের আলু ও ৩৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়া এবং ধান ১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। তবে গত দুদিনের পানির তোড়ে এসব ফসলের বেশির ভাগ খেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, পানি কমে আসাতে এখন ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমিগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। তবে এখনো ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। যেভাবে পানির স্রোত ছিল, তাতে ফসলের ক্ষতির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি আরেকটু কমে আসলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হবে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসানসহ উপজেলা প্রশাসন বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছে। এ সময় পানিবন্দি মানুষের মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্যসহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মুনিমুল হক বলেন, ইতোমধ্যে ৭ ইউনিয়নে ২০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পানিবন্দি লোকজনের মধ্যে ১ হাজার ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। নতুন করে ৫০ টন চাল ও ২ হাজার শুকনা খাবার বরাদ্দের জন্য আবেদন জানানো হয়।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসআর