সুগন্ধা নদীর অব্যাহত ভাঙনে তিন বছরে প্রায় দেড় শতাধিক বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। সর্বশেষ বিলীন হয়েছে প্রায় দুইশ বছরের পুরনো ঈদগাহ ও জামে মসজিদসহ পাঁচটি বাড়ি। আর ৭৫ মিটার ভাঙলে বরিশার বিমানবন্দরের একাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে রোববার (২৪ অক্টোবর) থেকে চার দিন ধরে অব্যাহতভাবে চলছে এই ভাঙন। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়সারা কাজের জন্য বছরের পর বছর নদীভাঙন চলছে। ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ীভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, সুগন্ধা নদীর বাহেরচর পয়েন্টের ভাঙন ঠেকাতে ব্লক বা বালুর বস্তা ফেলে সমাধান করা যাবে না। দরকার স্থায়ী সমাধান। এজন্য সাড়ে ১২শ কোটি এবং ৫০ কোটি টাকার ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভাঙন প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করবেন। এটা তাদের কাজ নয়।

স্থানীয় বাসিন্দা আবু হানিফ হাওলাদার বলেন, গত রোববার থেকে আবার ভাঙন শুরু হয়েছে। একটি মসজিদ, একটি ঈদগাহ, পাঁচটি বাড়ি, এক একর ফসলি জমি সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে সুগন্ধার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।

আরেক বাসিন্দা সিদ্দিক হাওলাদার বলেন, ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামটি নদীভাঙনে প্রায় বিলীন। এখন কিছু বাড়িঘর আছে। ভেবেছিলাম এ বছর ভাঙবে না। তাও ভাঙল। এখন খেতের কাঁচা ধান কেটে নিচ্ছি গরু-ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য। তিন বছরে ভাঙনে আমার ১৬০ শতাংশের মতো জমি শেষ হয়ে গেছে।

সেলিম নামে আরেকজন বলেন, ভাঙনের মুখে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বাড়িঘর নিয়ে গেছে প্রায় ২৫ পরিবার। কোনো বছরই ভাঙন থেকে রক্ষা পাচ্ছি না। সরকার থেকেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

তিনি বলেন, ভাঙন ঠেকাতে একবার কাজ এসেছিল। ঠিকাদার নদীর তীরে ব্লক তৈরি করেই চলে গেছেন। নদীতে আর ফলো হয়নি। হয়তো কাজ শেষের আগেই তিনি বিল পেয়ে গেছেন সেজন্য আর এদিকে আসেননি।

রহিম ঘরামি বলেন, আমার বাড়িঘর সব নিয়ে গেছে নদী। এখন থাকি অন্যের বাড়িতে। আমাদের কেউ কখনো সাহায্যও করেনি, নদী ভাঙনও ঠেকাতে কেউ আসেনি।

ক্ষুদ্রকাঠির বাসিন্দা শাহীন হোসেন বলেন, অনেক বছর ধরেই এই গ্রামে ভাঙন চলছে। কিন্তু ভাঙন প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখছি না। সুগন্ধা নদীকে যদি শাসন করা না যায় তাহলে ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না। আর এভাবে ভাঙন চলতে থাকলে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র বিমানবন্দরটিও ক্ষতির মুখে পড়বে। কারণ বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীর থেকে ভাঙন এলাকা মাত্র  আড়াইশ ফুট দূরত্বে।

স্থানীয় সাংবাদিক আরিফ হোসেন বলেন, আমার চোখের সামনে অনেক ঘর বিলীন হতে দেখিছি। রোববার থেকে শুরু হওয়া ভাঙনে অনেক মানুষ চোখের সামনে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এই অঞ্চলে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্ন সময়ে তালিকা করে নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তারা সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমীনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাঙনের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক সেখানে শুকনো খাবারসহ সহায়তা পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। এই কর্মকর্তা বলেন, ঘরবাড়ি হারানোদের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরের ব্যবস্থা করা হবে। তবে তা সময় সাপেক্ষ।

বরিশাল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক আ. রহিম তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাঙনের কারণে বিমানবন্দরের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন তথ্য আমার জানা নেই। যে অংশটি ভাঙছে বলে আপনি (প্রতিবেদক) বলছেন তা গ্রামের মধ্যে। ভাঙন প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমাদের আসলে করার কিছুই নেই।

বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাঙনের খবর পেয়েই আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ওখানে ১৫০ মিটার ধরে ভাঙছে। মূলত সুগন্ধা নদীর যে স্থানে ভাঙছে সেখানে গভীরতা এত বেশি যে সাময়িক কোনো পদক্ষেপে প্রতিহত করা যাবে না। ভাঙন ঠেকাতে হলে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার দরকার।

এই কর্মকর্তা বলেন, আর ৭৫ মিটার ভাঙলে বিমানবন্দরে ভাঙন শুরু হবে। যদিও ইতোমধ্যে আমরা ভাঙন ঠেকাতে মন্ত্রণালয়ে দুটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। বাবুগঞ্জে সুগন্ধা ও সন্ধ্যা নদী খুবই প্রমত্তা। এর সাতটি পয়েন্টে ভাঙন চলছে। এই সাতটি পয়েন্টে ভাঙন ঠেকাতে ১ হাজার ২৫৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব এবং ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া সুগন্ধা নদীর মাঝে জেগে ওঠা বাহেরচর ড্রেজিংয়ের জন্য ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প পাস হলে কাজ শুরু হবে। তবে সেটিও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এসপি