‘ডাক্তার আমাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার করেছেন। আমি হার্টের রোগী, দ্রুত ঢাকা যেতে হবে। ঢাকায় যাওয়ার জন্য স্ট্যান্ডে এসেছি। কিন্তু এখন তো যেতে পারব না। যাব কী করে? বাস তো বন্ধ। টিকেট ফেরত দিয়ে টাকা নিলাম। এখন ওষুধ খেয়ে বাসায় থাকতে হবে। আমি হার্টের রোগী, যদি কিছু হয়ে যায়? এ রকম হঠাৎ তেলসহ জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এবং কথায় কথায় পরিবহন ধর্মঘট আমাদের মতো মানুষের জন্য কষ্টকর।’

কথাগুলো বলছিলেন তছলিম উদ্দিন। বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে চাকরি করতেন তিনি। হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু দিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখান থেকে তাকে ঢাকায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে রেফার করেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রংপুর নগরের কামারপাড়া কোচস্ট্যান্ডে এসে জানতে পারেন পরিবহন ধর্মঘট চলছে।

শুক্রবার (০৫ নভেম্বর) ভোর ৬টা থেকে দেশের অন্যান্য জেলার মতো রংপুরেও চলছে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট। প্রতি লিটারে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বৃদ্ধির পর বিভাগীয় ও জেলার পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘটের কারণে বাস-ট্রাক-ট্যাংকলরিসহ পণ্যবাহী পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

শুক্রবার ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সরেজমিনে রংপুর নগরের কামারপাড়া কোচস্ট্যান্ড, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, ট্রাক টার্মিনাল, কুড়িগ্রাম বাস টার্মিনাল, মর্ডাণ মোড়ে দেখা গেছে, সেখান থেকে কোনো বাস ও ট্রাক চলাচল করছে না। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গাড়ি রাস্তায় নেমেছে। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ছোট ছোট যানবাহনে গন্তব্যে ছুটছেন তারা। এতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।

ধর্মঘটের কারণে রংপুর থেকে কাঁচামাল ও কৃষিজাত পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকাগামী পরীক্ষার্থী ও চিকিৎসাসেবা প্রত্যাশী মানুষজন সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। মালিক-শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত কেন্দ্রীয় নেতারাও। ভাড়া সমন্বয় না করে শুধু জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলছেন তারা।

নগরীর কামারপাড়া ঢাকা কোচস্ট্যান্ডে কথা হয় আতিকুর রহমান নামে এক চাকরিজীবীর সঙ্গে। তিনি রংপুরে এসেছিলেন তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ঢাকায় ফিরতে দুই দিন আগে টিকেটও কেটে রেখেছিলেন। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে তিনি পড়েছেন বিপাকে।

ঢাকা পোস্টকে আতিকুর রহমান বলেন, যেভাবেই হোক ঢাকা যেতে হবে। অফিস আদালত করতে হবে। আমার ছুটি শেষ। এখন চাকরি বাঁচাতে হলে ঢাকায় যেতেই হবে। আত্মীয়স্বজনসহ রংপুরে এসেছিলাম। কিন্তু এখন তো ধর্মঘটের কারণে যেতে পারছি না। আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।  

বাস কাউন্টারের ভিভেতরে মেয়েকে নিয়ে বসে চিন্তামগ্ন অভিভাবক আখেরুজ্জামান। নগরের কটকিপাড়ায় থাকেন তিনি। সকালে ঢাকা যেতে কোচস্ট্যান্ডে এসে জানতে পারেন ধর্মঘটের কারণে বাস চলাচল বন্ধ। মেয়ের পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আখেরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা রয়েছে। কিন্তু এখন তো বাস বন্ধ। চিন্তা করছি মেয়েকে নিয়ে কীভাবে ঢাকা যাব? পরীক্ষা তো দেওয়া লাগবে।’

একই অভিযোগ লালমনিরহাট থেকে আসা নাজমুল ইসলামের। তার স্ত্রীও পরীক্ষা দিতে ঢাকায় যাবেন। ট্রেনের টিকেট না পেয়ে রংপুরে এসেছেন বাসে করে যাত্রা করবেন বলে। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘটের কারণে পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে তারাও চিন্তিত।

ধর্মঘটে বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় চালক-শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দাবি করে শ্যামলী পরিবহনের চালক আল-আমিন বলেন, এটা তো আমাদের ডাকা ধর্মঘট নয়। বাস-ট্রাক মালিকদের ডাকা ধর্মঘট পালন করতে আমরা শ্রমিক, কর্মচারীরা বাধ্য। ম্যানেজাররা কাউন্টার বন্ধ করে রাখছে। আমরা অলস সময় কাটাচ্ছি। মালিক পক্ষ ছাড়া আমরা বলতে পারছি না কবে নাগাদ ধর্মঘট শেষ হবে। যাত্রীদের ভোগান্তি হচ্ছে। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

ট্রাকচালক সালাহউদ্দিন বলেন, ‘কোনো কথাবার্তা ছাড়াই হঠাৎ করে লিটারে ১৫ টাকা করে দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। সরকার তো তেলের দাম বাড়িয়েছে, গাড়ি ভাড়া বাড়ায়নি। এখন কারও কাছ থেকে বেশি ভাড়া চাওয়াটাও মুশকিল। আবার টোলও বাড়ানো হয়েছে। এজন্য একটা সিদ্ধান্ত আসা দরকার। মনগড়া কোনো সিদ্ধান্ত ভালো না। এখন সব জায়গায় দাম বাড়ার প্রভাব পড়বে।’

কামারপাড়া কোচস্ট্যান্ডে এনা পরিবহনের কাউন্টারের সহকারী ম্যানেজার তোতা মিয়া বলেন, ‘তেলের দাম বাড়বে কিন্তু এভাবে হঠাৎ লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো কতখানি যৌক্তিক? আমরা তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করছি। এখন বাস ভাড়া না বাড়ানো ছাড়া আমাদেরও উপায় থাকবে না। কিন্তু আমরা যাত্রীদের সুবিধার্থে তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সরকারকে পুনর্বিবেচনা করার দাবি করছি।’

কোনো ঘোষণা ছাড়াই কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বাড়ানো সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। বৃহস্পতিবার (০৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির কার্যালয়ে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। 

তিনি বলেছেন, দেশের ৭০ শতাংশ অর্থনীতি সড়ক পথে নির্ভরশীল। গাড়ির চাকা না ঘুরলে স্থবির হবে সব কিছু। হঠাৎ করে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। এটি সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গোটা দেশে এর প্রভাব পড়বে।

এদিকে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। রবি মৌসুমের শুরুতেই হঠাৎ খরচ বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। কৃষক ও ক্ষেতমজুর আন্দোলনের নেতা পলাশ কান্তি নাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর মধ্যেই ডিজেলের দাম বৃদ্ধির খবরে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন চাষিরা। সাধারণত এক বিঘা জমিতে আলু চাষে খরচ হয় ১০-১২ হাজার টাকা। কিন্তু তেলের দাম বৃদ্ধিতে সেই খরচে যোগ হলো বিঘা প্রতি আরও ৫-৬ হাজার টাকা। আর বাড়তি এই খরচ নতুন দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে উৎপাদকদের মনে। তেলের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ায় ফসল উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে ত্রিশ শতাংশ। এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রসঙ্গত, বুধবার (০৩ নভেম্বর) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি গেজেটে লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে প্রতি লিটার কেরোসিন ও ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা করে। এর আগে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রি হতো ৬৫ টাকা করে।

এসপি