দর্শক হৃদয়ে ‘নিল ললিতার গীত’
নাটকের শুরুতেই ভাওয়াইয়ার সুর। থেমে থেমে সংলাপ আর পালার আদলে নৃত্য। রংপুরের আঞ্চলিকতা আবার কখনও শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ। ভালো লাগা থেকে নিলের জীবনসঙ্গী হতে বিয়ের পিঁড়িতে ললিতা। এগুতে থাকে নাটকের দৃশ্যায়ন। তখন দর্শক সারি পূর্ণ। হৃদয়ছোঁয়া সংলাপ আর নাটকীয় ভঙ্গিমায় মুহুর্মুহু করতালি। এভাবেই রাত পৌনে ৮-৯টা পর্যন্ত দর্শক মেতেছিল ‘নিল ললিতার গীতের’ মঞ্চায়ন দেখে।
শুক্রবার (০৫ নভেম্বর) রাতে নবনির্মিত রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে পালা নাটকটি মঞ্চস্থ করে রংপুর নাট্যকেন্দ্র। এটি ছিল নাট্যকেন্দ্রের ২৩ বছরপূর্তি উপলক্ষে চার দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের সমাপনী দিনের পরিবেশনা।
বিজ্ঞাপন
‘নিল ললিতার গীত’ নাটকের রচয়িতা পালাকার সায়িক সিদ্দিকী। তিনি নিজেই এর নির্দেশনায় ছিলেন। মূলত দেশীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাকে তুলে ধরা হয়েছে সোয়া এক ঘণ্টার এই নাটকে। যেখানে নিলের ভালোবাসার সুন্দরী ললিতা নারী লোভি আজগরের যৌন লালসার শিকার হন। কুরুচিপূর্ণ সমালোচনায় ললিতার প্রতি বিশ্বাস হারায় নিল। ভেঙে যায় সুখের সংসার। দুঃখের দরিয়ায় ভাসা ললিতা প্রাণ বিসর্জন দেয় বিষপানে। নাটকের শেষটাও হয় হৃদয় ছোয়া বেদনার সুর ভাওয়াইয়ায়।
বিজ্ঞাপন
নাটকটির রচয়িতা সায়িক সিদ্দিকী জানান, বাংলা লোকনাট্যের অন্যতম এক নিদর্শন পালাগান। রূপবৈচিত্র্যের আবহে পালাগান দেশীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাকে উপস্থাপন করে। ‘নিল ললিতার গীত’ পালায় রংপুর অঞ্চলের সংস্কৃতিকে নানারূপে তুলে আনতে চেষ্টা করা হয়েছে। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা ও সরল প্রেমকে উপজীব্য করে এই পালা নাটকটির মঞ্চায়ন।
১৫ জন শিল্পী মঞ্চে ‘নিল ললিতার গীত' পরিবেশনে অংশ নেন। নেপথ্যে ছিল আরও পাঁচজন। এটি ছিল রংপুর নাট্যকেন্দ্রের ২৯তম প্রযোজনা। কলাকুশলীদের মেকআপ, পোশাকসজ্জা, সংলাপ, নৃত্য আর সঙ্গীতের সুরের সঙ্গে মঞ্চে আলোক প্রক্ষেপণে পালাটি মন কাড়ে দর্শকদের। নবনির্মিত জেলা শিল্পকলা একাডেমির এখনও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি। তার আগে টেকনিকেল শো হিসেবে উৎসবের সমাপনী দিনে নাট্যকেন্দ্র জনপ্রিয় এই পালা নাটকের মঞ্চায়ন করে।
নাট্যোৎসবের সমাপনী আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাট্যকেন্দ্রের সভাপতি মাহবুবুল আলম খান। সম্মানিত অতিথি ছিলেন নাট্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নাট্যজন কাজী মো. জুননুন, রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার নুঝাত তাবাসসুম রিমু। স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক রাজ্জাক মুরাদ।
নাটক শেষে দর্শক সারিতে থাকা হাসনাইন আহম্মেদ নয়নের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। পেশায় তিনি সরকারি চাকরিজীবী। ছুটির দিন হওয়ায় পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে নাটক দেখতে এসেছিলেন। ঢাকা পোস্টকে হাসনাইন আহম্মেদ বলেন, এ ধরনের নাটক অনেক বছর পর দেখলাম। এখন তো আগের মতো নাটকের মঞ্চায়ন নেই। তবে নাট্যকেন্দ্র খুবই সুন্দর একটি নাটক মঞ্চায়ন করেছে। নাটকের সংলাপে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা, ভাওয়াইয়ার সুর এবং পুরোনো দিনের সেই পালাগানের আবহ খুবই ভালো লেগেছে।
কথা হয় পল্লবী সরকার ও পুষ্পিতা সরকারের সঙ্গে। তারা দুজন সম্পর্কে বোন। নাটক দেখতে এসে মিলনায়নের দ্বিতীয় তলার দর্শক সারিতে আসন না পেয়ে বসেছিলেন তৃতীয় তলায়। সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, নতুন শিল্পকলা একাডেমি যেমন সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন লাগছে, তেমনি নিল ললিতার গীত নাটকটিও বেশ হৃদয় কেড়েছে। সবার অভিনয় আর গানে নাচে ভাওয়াইয়ার উপস্থাপন খুবই ভালো লেগেছে।
উল্লেখ্য, গত ২ নভেম্বর রংপুর নাট্যকেন্দ্র আয়োজিত চার দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনী দিনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শেষে সংগঠনের কার্যালয়ে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর পর দিন ৩ নভেম্বর রংপুর টাউন হল মঞ্চে সুমিত মোহন্তের রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চায়ন হয় ‘মাইডাসের স্বপ্ন স্বর্ণ’ নাটক। তৃতীয় দিনে একই মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে সুমিত মোহন্তের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় শাস্তি নাটক মঞ্চায়ন করে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি