সাঁওতালপল্লিতে হামলা-হত্যার ৫ বছরেও শুরু হয়নি বিচার
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালপল্লি হামলা ও হত্যা ঘটনার ৫ বছর আজ। ২০১৬ সালের এই দিনে আগুন দেওয়া হয় সাঁওতালদের কয়েকশ বাড়িঘরে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি আজও। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হামলার ৫ বছরেও বিচার পাননি তারা; উল্টো বাপ-দাদার জমিতে ইপিজেড স্থাপনের সিন্ধান্তে আবার তাদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর, সাহেবগঞ্জ খামারের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে সাঁওতাল-বাঙালিদের। সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন আহত ও মারা যান শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ নামে তিন সাঁওতাল। এরপর কয়েকশ বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
এই ঘটনার পর গেলে ৫ বছর ধরে কেউ অস্থায়ী, কেউবা বিরোধপূর্ণ জমি দখলে নিয়েই বসবাস করছেন। তবে সেদিনের তা-বের কথা আজও ভুলতে পারেনি হতাহত পরিবারসহ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ। অনেকে বেঁচে আছেন শরীরে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
সাঁওতালপল্লিতে হামলা, আগুন ও হত্যার ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই আদালতে প্রতিবেদন (চার্জশিট) জমা দেয় পিবিআই। কিন্তু চার্জশিটে এজাহারনামীয় ১১ আসামিকে বাদ দেওয়ায় অভিযোগে গোবিন্দগঞ্জের আদালতে নারাজি মামলা করেন সাঁওতালরা।
তাদের অভিযোগ, আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরে মামলার মূল অভিযুক্ত আসামিরাও। ঘটনার ৫ বছর হলেও এখনো বিচার পায়নি তারা। উল্টো বাপ-দাদার জমিতে ইপিজেড নির্মাণের সিন্ধান্তে আবারও উচ্ছেদের শংঙ্কায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ।
সাঁওতালপল্লির জয়পুর গ্রামের ফুলমনি হেমরম বলেন, ‘এটা আমার বাপ-দাদার পৈত্রিক জমি। সরকারের উচিত এটা আমাদেরকে ফেরত দেওয়া। আমাদের সরিয়ে এখানে ইপিজেড করা চলবে না। প্রয়োজনে জীবন দেব, তবুও এখানে ইপিজেড হতে দেব না।’
৬ নভেম্বর হামলার সময় গুলিতে পা হারানো বিমল কিসকু বলেন, ‘সে দিনের হামলার কথা মনে আজও গা শিউরে ওঠে। এই যে আমরা গুলিবিদ্ধ হইছি; আমরা কোনো অনুদান পাইনি। উল্টো এখন আমাদের জায়গায় ইপিজেড নির্মাণের পাঁয়তারা করছে সরকার। আমরা এটা হতে দেব না।’
শোবহান মুরমুরও গুলিবিদ্ধ হন সেদিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এলোপাথাড়ি ছোড়া গুলিতে তার একটি পা ও বুক ক্ষতবিক্ষত হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে ফেরেন। তবে এখন আর ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না তিনি।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি বার্নাবাস টুডু বলেন, ‘আমাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হইছে। পুলিশ নির্যাতন করছে। এলাকার প্রভাবশালীরা নির্যাতন করছে। গুলি করে তিন ভাইকে মারছে। আমাদের ঘরে আগুন লাগে দিছে। লুটপাট করছে।’
এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম প্রধান বলেন, ‘এই লুটপাট; ধ্বংস লীলা কেন হল? প্রশাসন দিয়ে গুলি চালানোর পরেও আসামিরা দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। উল্টো আদিবাসীদের একটার পর একটা মামলা দিচ্ছে।’
ইপিজেডের ব্যাপারে এই সাঁওতাল নেতা আরও বলেন, ‘আমরাও দেশের উন্নয়ন চাই। তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ আর নিঃস্ব করে সেই উন্নয়ন করাটা কতটা যৌক্তিক? সরকার দ্রুত ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণাও দেন তিনি।
রাষ্টপক্ষের আইনজীবী মো. মিজানুর রহমান বলেন, চার্জশিট দাখিলের পর বাদীর নারাজি মামলার কারণে আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হতে বেশি সময় লাগছে। তবে এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার কথা জানান তিনি।
আধিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ গাইবান্ধার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, হামলায় জড়িত আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে বিচার ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি লিজের শর্ত অনুযায়ী আদিবাসী সাঁওতালদের তাদের জমি বুঝে দেয়া উচিত। এছাড়াও বিরোধপূর্ণ জায়গায় ইপিজেড নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসা দরকার।
নিহতদের স্মরণে দিনটিকে সাঁওতাল হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীরা। দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছে শোক র্যালি ও সমাবেশসহ নানা কর্মসূচির।
রিপন আকন্দ/এমএসআর