রংপুরের হারাগাছে পুলিশের নির্যাতনে তাজুল ইসলাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর অভিযোগে উঠলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বলছে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। নিহতের শরীরে শারীরিক নির্যাতন বা আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এর আগে তাজুলের মৃত্যুর ঘটনায় মরদেহের সুরতহাল রিপোর্টে আঘাতের চিহ্ন ছিল না বলেও জানানো হয়। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি অ্যান্ড মিডিয়া) সাজ্জাদ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

নিহতের ছোট ভাই মর্তুজার রহমান আবু বাদী হয়ে সোমবার (১ নভ্ম্বের) রাতে হারাগাছ থানায় অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা করেন। ঘটনার রাতেই মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তাজুল ইসলাম হারাগাছ পৌর এলাকার দালালহাট নয়াটারী গ্রামের মৃত শওকত আলীর ছেলে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) ফরেনসিক বিভাগ থেকে তাজুলের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে তাজুলের মৃত্যু স্ট্রোককজনিত কারণে হয়েছে বলা হয়। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে তাজুলের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলাম। এর আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেছেন।

কেন পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে মেট্রোপলিটন হারাগাছ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকত আলী সরকার জানান, ঘটনার দিন সোমবার সন্ধ্যায় মাদকবিরোধী অভিযানের সময়ে নতুন বাজার বছিবানিয়ার তেপতি থেকে তাজুল ইসলামকে মাদকসহ আটক করে হাতকড়া পরানো হয়। এতে ভয়ে সে মলত্যাগ করে ফেলে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ হাতকড়া খুলে দেয়। এর পর পুলিশ তাজুলকে স্থানীয়দের জিম্মায় দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এর কিছুক্ষণ পর খবর আসে যে তাজুল ইসলাম মারা গেছেন।

তিনি আরও জানান, এলাকাবাসী ভুল তথ্য পেয়ে থানা ঘেরাও করে ভাঙচুর করে। অথচ পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়নি। এটা প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানেন এবং তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের গুজব ছড়িয়ে কতিপয় লোকজন থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ মিছিল ও ভাঙচুর চালিয়েছে।

ওসি শওকত আলী জানান, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তাজুল ইসলামের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি উল্লেখ রয়েছে। হাইকোর্টকে প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে থানা ঘেরাও করে হামলা, ভাঙচুর এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

হারাগাছের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন

এ ঘটনা তদন্তে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মেহেদুল করীমকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছেন সহকারী পুলিশ কমিশনার (পরশুরাম জোন) আরিফুজ্জামান, উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিএসবি) আবু বক্কর সিদ্দিক ও উপ-পলিশ কমিশনার (ডিবি) কাজী মুত্তাকী ইবনে মিনান। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করেছে।

হাইকোর্টের নজরে হারাগাছ

৩ নভেম্বর বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল ও আদেশ দেন। আদেশে তাজুল ইসলামকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত ৪ সদস্যের কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আগামী ১১ নভেম্বরের মধ্যে মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও অপমৃত্যুর মামলার অনুলিপি আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

গ্রেফতারভীতি কাটছে না

ওই ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা করেছেন। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়েছে। একটি মাদক উদ্ধারের মামলা, অপরটি থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের পাশাপাশি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

ঘটনার পর থেকে স্থানীয় এলাকাবাসী স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তাদের চলাফেরা থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু ঘটনার ছয় দিনেও কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় অনেকই অজানা ভীতিতে রয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের কাছে ঘটনার দিনের ভিডিও ফুটেজ আছে। ওই দিন হারাগাছে বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মীরাও ছিল। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেওয়া ভিডিও ফুটেজ এবং ছবি দেখে দেখে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে তালিকা পুলিশ তৈরি করেছে। কখন কে গ্রেফতার হবে, এই ভীতি এখন সবার মনে।

উল্লেখ্য, ২৪ সেপ্টেম্বর সাহেবগঞ্জ এলাকায় মাদকসেবীকে ধরতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে আহত হন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পিয়ারুল ইসলাম। এ ঘটনার পরদিন তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার ঠিক ৩৬ দিন পর এবার পুলিশের বিরুদ্ধে মাদকসেবী তাজুলকে আটকের পর পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসআর