রক্ত উপহার দেওয়া সংগঠনটি করোনাকালে পাশে দাঁড়িয়েছে অসহায়দের

শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলা। পাঁচ বছর আগেও এখানে অসুস্থ ব্যক্তির জন্য জরুরি রক্তের দরকার হলে বিপাকে পড়তেন স্বজনেরা। কিন্তু এখন কারো রক্ত লাগলে মুহূর্তেই পাশে দাঁড়ান ছয়শ রক্তদাতা। তারা ব্লড ট্রান্সফিউশন অর্গানাইজেশন (বিটিও) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য। রক্ত উপহার দেওয়াই তাদের নেশা। 

শুরুটা পাঁচ বছর আগে, ২০১৬ সালে। ১২ বন্ধুর আড্ডাখানা থেকে পরিকল্পনা। মহৎ এই উদ্যোগে একে একে যুক্ত হয়েছেন ছয়শ মানুষ। রক্তের দরকার জানলেই তারা পাশে এসে দাঁড়ান। যে সদস্যের সঙ্গে রোগীর রক্তের গ্রুপ মেলে তিনিই ছুটে গিয়ে রক্ত উপহার দেন। 

আশিম নামের এক সেবাপ্রাপক বলেন, ডামুড্যা ক্লিনিকে আমার স্ত্রী সন্তান প্রসব করেছেন। এরপর ডাক্তার জানালেন দ্রুত ‘ও পজিটিভ’ রক্ত দরকার। রক্ত জোগাড় নিয়ে আমাকে একটুও দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। কারণ, আমি জানি পাশে আছে ‘বিটিও’। ডাকতেই আধাঘণ্টার মধ্যে বিটিএ সদস্য দেবদূতের মতো পাশে এসে হাজির। রক্ত দেওয়ার পর মনে হলো আমার চেয়ে রক্তদাতাই বেশি সুখী হয়েছেন। 

সংগঠনের সদস্য খোরশেদ আলম টিপু। এখন পর্যন্ত ১৯ বার রক্ত উপহার দিয়েছেন। তিনি বললেন, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। রক্ত উপহার দিয়ে আমরা যে খুব মহান কাজ করছি এমন আত্ম-অহংকারের কিছু নেই। আসলে রক্ত উপহার দিলে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা বলে বোঝানো যাবে না। তাছাড়া নিয়মিত রক্ত দেওয়া নিজের স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। 

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পাপ্পু শিকদার বলেন, শুরু করেছিলাম আমরা ১২ বন্ধু। এরপর স্রোতের মতো মানুষ এসে সংগঠনটিতে মিশে গেছে। পাঁচ বছর ধরে আমরা রক্ত উপহার দিচ্ছি। সামান্য রক্ত যে কত অসামান্য উপহার তা কেবল যিনি দাতা এবং গ্রহীতাই বোঝেন। রক্ত উপহার দিয়ে আনন্দে কতবার কতজনকে যে কাঁদতে দেখেছি! মানবসেবাই পরম ধর্ম। রক্ত উপহার দেওয়ার মতো এমন নেশা আর নেই। 

সংগঠনের সভাপতি নিপু মাদবর বলেন, সংগঠনে সকল গ্রুপের রক্তের সদস্য রয়েছে। তাই রক্তের প্রয়োজন হলে কাউকে নিরাশ হতে হয় না। দিনরাত যখনই দরকার পাশে আছে বিটিও। 

সাংগঠনিক নীতিমালা সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ভালোবাসা ও মানবসেবাই আমাদের নীতিমালা। কারো রক্তের দরকার জানতে পারলে আমাদের আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, বার্তাটি গ্রুপের সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। এরপর যাদের সঙ্গে গ্রুপ মেলে তারা দ্রুত সাড়া দেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হয় কে কত দ্রুত রক্ত দেওয়ার স্থানে পৌঁছাতে পারবেন। এটা স্থির হলে ব্যাকআপ হিসেবে বাকিদের রাখা হয়। 

সংগঠনের তেমন কোনো নীতিমালা বা ধরাবাঁধা নিয়মাবলী না থাকলেও একটি বিষয় কঠিনভাবে মানা হয়। সেটি হচ্ছে এই সংগঠনের কেউই রক্ত উপহার দেওয়ার পর গ্রহীতাদের অফার করা কিছু খান না। এর কারণ জানিয়ে নিপু বলেন, কিছু মানুষ আছেন যারা রক্ত বিক্রি করেন। নানাভাবে বিপদে পড়া মানুষকে ব্ল্যাকমেইলও করেন। তাদের কেউ যেন আমাদের সংগঠনের সদস্য বলে পরিচয় দিতে না পারেন সেজন্য আমরা রক্তগ্রহীতার চা-নাস্তার অফার বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দেই। তাছাড়া অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য টাকা খরচ হয়। এমন বিপদের সময় আমাদের পেছনে তাদের পয়সা খরচ হোক চাই না।  

রক্ত উপহার দেওয়া এই সংগঠনটি করোনাকালে খাদ্যসামগ্রীও উপহার দিয়েছে অসহায়দের। সংগঠনের সদস্যরা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে জানালেন নিপু। 

ডামুড্যা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিকের পরিচালক আব্দুস সত্তার বলেন, রক্তের অভাবে এক সময় এই উপজেলায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সেই দিন আর নেই। আমাদের ক্লিনিকে যখনই কারো রক্তের প্রয়োজন হয়, তখনই বিটিওকে পাশে পাই। 

এইচকে