প্রাকৃতিক ভেষজগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ চুইঝালের কদর দিন দিন বেড়ে চলেছে। সারাদেশে খুলনার চুইঝালের চারার কদর রয়েছে। মাটিতে কিংবা অন্য গাছের আশ্রয়ে লতার মতো বেড়ে ওঠে চুইঝাল গাছ। চুইঝালের পাতা, কাণ্ড, শেকড়, ফুল, ফল, ডাল সবই ঔষধি গুণসম্পন্ন। এখন চুইগুঁড়ার ব্যবহারও শুরু হয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যা বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে।

স্বাদে অতুলনীয় এই মসলা গরু, খাসি, মুরগি ও হাঁসের মাংসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের তরকারিতেও ব্যবহার করা হয়। কাণ্ড, বাকল, শেকড় তরকারিতে ব্যবহার করা হলেও এবার চুইঝালের মসলার স্থায়িত্ব বাড়াতে যুক্ত হয়েছে নতুনত্ব। ক্রেতাদের সুবিধার জন্য চুইঝালের পাউডার (গুঁড়া) মশলা তৈরি করে নতুন রূপ দিয়েছেন খুলনার কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক ও নিউটন মন্ডল।

বর্তমানে চুইগুঁড়ার ব্যবহারও শুরু হয়েছে।  অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে শেকড়, বাকল, ডাল রোদে শুকিয়ে মেশিনে গুঁড়া করে চুইয়ের গুঁড়া মশলা তৈরি করছেন তারা। আর এই গুঁড়া মসলা শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, যাবে বিদেশেও। প্রথমবারের মতো চুইঝালের গুঁড়া মসলা পাঠানো হচ্ছে থাইল্যান্ডে।

কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৭ সালে কৃষি অফিসের সহায়তায় চুইঝালকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে কাজ শুরু করি। ২০১৮ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চুইয়ের চারা বিক্রি শুরু করি আমি ও নিউটন। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি আমাদের। নিজেদের উৎপাদিত চুই ঝালের পাশাপাশি অন্য কৃষকদের কাছ থেকে এই চুইঝালের শেকড়, কাণ্ড, লতা কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছি।

চুইঝাল গাছ

তবে চুইলতা কাটার পর এর শেকড়, বাকল, ডাল বেশিদিন রাখা সম্ভব হয় না। শুকিয়ে কাঠে পরিণত হলে সেটি আর মসলা হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। আবার চুই এর কাঁচা ডাল, শেকড় ও লতা কুরিয়ার করে পাঠাতে অনেক সময় ২/৩ দিন লেগে যায়। এতে চুইঝাল নষ্ট হয়ে যায় বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, চুইঝাল নষ্ট হওয়া বন্ধ করতে ও নতুন রুপ দিতে কৃষি কর্মকর্তা মোসাদ্দেক হোসেনের পরামর্শে চুইঝালের পাউডার তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। সেই অনুযায়ী গুঁড়া মশলা তৈরি করে খেয়েছি, যা খুবই সুস্বাদু। তবে চুইঝাল চিবিয়ে খেয়ে যেই স্বাদ পাওয়া যায়, সেটি গুঁড়া মসলায় পাওয়া যাবে না। কিন্তু গুড়া মসলায় দারুণ একটা স্বাদ রয়েছে। এখন এই চুইয়ের পাউডার সাতক্ষীরার সাঈদ ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো থাইল্যান্ড পাঠানো হবে। দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজার ধরতে পারলে চুইঝালের কদর বহুগুণে বেড়ে যাবে।

নবদ্বীপ মল্লিকের পিতা সুভাষ মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেড় বছর থেকে ৫ বছর বয়সী চুইঝাল খেতে সুস্বাদু। চুইঝাল গাছ দুই রকমের হয়। একটি ঝুটো চুই (মাটিতে হয়) আরেকটি গাছ চুই (অন্য গাছের সঙ্গে লতার মতো ওঠে যায়)। দুই চুইঝালের দুই রকম স্বাদ। তবে ঝুটো চুইঝালে স্বাদ বেশি।

তিনি আরও বলেন, চুইঝালের পাউডার তৈরির জন্য চুইগাছ কেটে এনে সেটিকে জল দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। একটি কাঠের কাণ্ডে রেখে চুইঝাল ছোট ছোট টুকরো করে কাটতে হয়। কাটার পর রোদে শুকাতে হয়। রোদে শুকানোর পর কম হলে বাড়িতে ব্লেন্ডারে আর বেশি হলে মিলে নিয়ে মেশিনে গুঁড়ো করা হয়। তারপর গুঁড়া মসলা প্যাকেট করে বাইরে বিক্রি করা হয়।

কৃষক নবদ্বীপ মল্লিকের স্ত্রী মুক্তা মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূলত চুইঝালের মসলা মুড়িঘণ্ট, মাংসে ব্যবহার করা হয়। খিচুড়িতে ও মুড়িমাখাতে ব্যবহার করা যায়। চুইঝালের আসলে অনেকগুলো ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া চুই ঝালের গুঁড়োও অনেকভাবে ব্যবহার করা যায়। প্রত্যেক তরিতরকারিতে দেওয়া যায় মসলা হিসেবে।

কৃষক নিউটন মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, চুইগাছের শেকড়, ডাল বিক্রি করে অনেক সময় উপযুক্ত দাম পায় না কৃষকরা। আমরা সেই বিষয়টি বিবেচনা করে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে চুইঝালের পাউডার তৈরির কাজ শুরু করি। প্রথমবার পাউডার তৈরি করে খেয়েছি এবং অন্যদের দিয়েছি, খুবই ভালো সুস্বাদু। এবার আমরা ১ কেজি চুইঝালের গুঁড়ামসলা থাইল্যন্ডে পাঠাচ্ছি।ৎ

তিনি বলেন, থাইল্যান্ড পাঠানোর পরে সাড়া মিললে যারা আমাদের কাছ থেকে চারা নেয় তাদের উৎপাদিত চুই কিনে নিয়ে পাউডার করব। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিদেশি চুই রফতানি করব। ১২ কেজি চুইয়ের শেকড়, ডাল শুকিয়ে এক কেজি পাউডার তৈরি হয়। ফলে এর দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। আমরা পাউডারের মান ও প্রকারভেদে দাম নির্ধারণ করেছি। কেজিপ্রতি ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মানভেদে চুইঝালের পাউডার বিক্রি করা হবে।

ডুমুরিয়া উপজেলা সিনিয়র কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোসাদ্দেক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চুই একটি উচ্চমূল্যের ফসল এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। চুই খেলে অনেক রোগের উপকার হয়। বিশেষ করে যারা বৃদ্ধ মানুষ, যাদের গিঁটে গিঁটে ব্যথা হয়; তারা যদি নিয়মিত চুই খায় তাহলে এই ব্যথা নিরাময় হয়। চুইঝাল বিক্রি করতে কোনো সমস্যা হয় না। দীর্ঘদিন ধরে খুলনা এলাকাতে বিক্ষিপ্তভাবে চুইঝালের চাষ হয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সহযোগিতায় দুইজন কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক ও নিউটন মন্ডল সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকীকরণের জন্য একটি প্রকল্পের সহযোগিতা পেয়ে প্রথমে প্রদর্শনী আকারে মাতৃগাছ তৈরি করে। তারপর থেকে চারাগাছ তৈরি করে বিক্রি করেছেন। এ বছর পর্যন্ত তারা জন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও চাহিদা রয়েছে চুইঝালের। এর কাণ্ড, শেকড় পাঠলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তারা চুইয়ের প্রকৃত স্বাদ সেটি গ্রহণ করতে পারে না। এজন্য নবদ্বীপ মল্লিক এবং নিউটন মন্ডল স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্লেন্ডারের মাধ্যমে চুইঝালের গুঁড়ো তৈরির পর পাউডারটি বিদেশে পাঠাচ্ছে। প্রথম চালান তারা থাইল্যান্ডের পাঠাচ্ছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, চুইঝাল যাতে অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে যায়, সেজন্য আমাদের একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরের প্রত্যেকটা উপজেলায় ৪/৫টি চুইগ্রাম হবে। গ্রামের প্রতিটি সদস্যের বাড়িতে অন্তত দুইটি করে চুইঝাল গাছ লাগানো হবে।

এমএসআর