খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি একসময় ছিল বৃষ্টিনির্ভর। চার দশক আগেও কেবল ধানই ছিল এই অঞ্চলের প্রধান ফসল। খাবার জোগাতে কৃষকদের নিত্য লড়াই করতে হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে। তবে এখানকার কৃষকদের মুক্তির দিশা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন ‘প্রকৃতিবিজ্ঞানী’ নূর মোহাম্মদ।

রাজশাহীর তানোরের নূর মোহাম্মদ বংশপরম্পরায় কৃষক। বাবা-দাদাদের দেখেছেন ফসল ফলাতে গিয়ে খরার সঙ্গে লড়তে। ফসলহানিও দেখেছেন মাঠে। শৈশবে তার মনে দাগ কেটে যায়। ভাবতে থাকেন এ থেকে মুক্তির উপায়। তখন থেকেই বাবার ধানখেতের কোণে আলাদা করে ধান চাষ করতেন। পরিচর্যা-কাটা-মাড়াইও করতেন আলাদা।

অভাবের সংসারে বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেননি। মাধ্যমিকেই ইস্তফা দিতে হয়। একপর্যায়ে পুরোদস্তুর কৃষক বনে যান নূর মোহাম্মদ। কিন্তু ববাবরই ছিল খরা মুক্তির প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টায় তানোরের গোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ এই কৃষক এখন আপদমস্তক ‘বিজ্ঞানী’। অনায়াসেই করতে পারেন ধানের সংকরায়ণ।

২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদক নেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে

দীর্ঘ গবেষণায় উদ্ভাবন করেছেন ধানের দুই শতাধিক কৌলিক সারি। প্রচলিত জাতকে উজ্জীবিত করে জীবনকাল কমিয়ে এনেছেন। কোনোটির আবার ফলন বাড়িয়েছেন, খরাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বহু জাতের ধানও রয়েছে তার সংগ্রহে। একা হাতে গড়ে তুলেছেন ‘নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিসেবা’। এককথায় প্রকৃতিই তাকে বিজ্ঞানী বানিয়েছে।

কীভাবে এই কাজের শুরু, সেই গল্পও শুনিয়েছেন নূর মোহাম্মদ। বলেন, আমি স্বশিক্ষিত কৃষক। বাবা ও দাদা এমনকি বাবার দাদাও কৃষক ছিলেন। আগে খরায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ধানের ভালো ফলন হতো না। বিষয়টি মাথায় রেখেই আমি খরাসহনশীল ধানের জাতের সংকরায়ণকাজ শুরু করি। এ কাজের খুঁটিনাটি শিখেছি এই অঞ্চলের কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে মিশে।

দীর্ঘদিন গবেষণায় সংকরায়ণ ও বাছাইকরণের মাধ্যমে দুই শতাধিক ধানের সারি উদ্ভাবন করেন নূর মোহাম্মদ। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি কৌলিক সারি জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য। উচ্চফলনশীল, সল্প মেয়াদি, সরু ও সুগন্ধি যুক্ত, পোকামাকড় ও রোগবালাই কম, ধানগাছ শক্ত এবং খরাসহিষ্ণু। উদ্ভাবিত এসব জাতের ধান আগ্রহী কৃষকদের মাঝে বিতরণও করেছেন তিনি।

গোল্লাপাড়া বাজারের অদূরেই নূর মোহাম্মদের ধান গবেষণার মাঠ। ছোট ছোট প্লটে নানা জাতের ধানগাছ বেড়ে উঠেছে। সংকেত দিয়ে সব চিহ্নিত করা হয়েছে। মাঠের বড় অংশজুড়ে চাষ হয়েছে ধানের। এ মাঠেই রয়েছে এই কৃষকের উদ্ভাবিত ডায়ারেটিক চাল, কালো চাল, লাল চাল, যমজ চালসহ নানা প্রজাতির ধান। ধানখেতের আইলে শোভা পাচ্ছে নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিসেবার সাইনবোর্ড।

নিজের গবেষণার মাঠ ঘুরিয়ে দেখালেন তিনি। জানান, এ মৌসুমে তিনি ৬২ প্রজাতির ধান রোপণ করেন। এরই মধ্যে কিছু পেকেছে, সেগুলো কেটে ঘরে তুলেছেন; কিছু কাটা অবস্থায় মাঠে পড়ে আছে, কিছু ধান এখনো সতেজ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

নূরের লক্ষ্য, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাষিদের ভাগ্যোন্নয়ন করা। এ জন্যই সংকরায়ণের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন এবং তা চাষিদের মধ্যে পৌঁছে দিতে চান।

গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৫ সালে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পান কৃষক নূর মোহাম্মদ। এ ছাড়া ২০১৭ সালে পান বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদক। তিনি জানিয়েছেন, পদক পাওয়ায় তার কাজের গতি বেড়ে গেছে। তবে সংকট আছে। গবেষণার জন্য তার ল্যাব নেই। মাটির ঘরেই ল্যাব। সেখানেই সংকরায়ণ করেন। সেখানেই বীজ সংগ্রহ করেন। আধুনিক ল্যাব প্রয়োজন। কিন্তু অর্থাভাবে সেটি করতে পারেননি।

নূর মোহাম্মদ প্রকৃতির শেখানো বিজ্ঞানী বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরুল মতিন। তার কাছেও বিভিন্ন সময় পরামর্শ নিতে আসেন নূর মোহাম্মদ। তিনিও যান ওই কৃষকের ক্ষেতে।

ড. নূরুল মতিন বলেন, নূর মোহাম্মদের প্রতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি নেই। তারপরও গবেষক-বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে এসে কিছু কাজ শিখেছেন। বিভিন্ন সময় এসে পরার্শ নিয়েছেন। খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করেছেন। মাটির ঘর তার গবেষণাগার। বহু পুরোনো ধানের জাতের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণে রেখেছেন নূর মোহাম্মদ। সাধারণত জার্মপ্লাজম সংরক্ষণে উচ্চ প্রযুক্তি এবং ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি প্রয়োজন।

কিন্তু একেবারেই প্রাকৃতিকভাবেই সেগুলো সংরক্ষণ করেছেন তিনি। দু-এক বছর পরপর মাঠে দিয়ে সেগুলোর নতুন বীজ সংরক্ষণ করে। কোনো ধরনের প্রণোদনা ছাড়াই নিজ উদ্যোগে এ কাজটি তিনি করে চলেছেন। তার প্রচেষ্টা ভালো।

এই অধ্যাপক যোগ করেন, এ ধরনের গবেষণায় সংকরায়ণ হলো প্রধান কৌশল। সেটি তিনি অনায়াসেই করতে পারেন। পরবর্তীতে সেগুলো মাঠে দিয়ে তথ্য সংগ্রহ, সন্নিবেশ ও বিশ্লেষণ করতে হয়। সেগুলো হয়তো তিনি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে করতে পারেন না। লাইন তৈরির জন্য ভালো বৈশিষ্ট্যগুলো বেছে নেওয়া দরকার, সেটিও তিনি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। এটি তার বাস্তব কর্ম অভিজ্ঞতা। শিক্ষার পাশাপাশি অভিজ্ঞতাও জরুরি। এটি তিনি প্রকৃতিগতভাবে অর্জন করেছেন।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল জানান, তিনি কৃষক হলেও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তার আগ্রহ বিভিন্ন ফসলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা। তিনি ধানের সংকরায়ণ কৌশল তিনি জানেন এবং এটি কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। গণবাছাইও করেন।

তিনি আরও বলেন, এসব তার পেশা নয়, নেশা থেকেই করেন। কিন্তু এটা করে তিনি যে আশ্চর্যজনক কিছু করতে পেরেছেন, সেটি নয়। হয়তো এই সাধানা করতে করতে একদিন তিনি জাতিকে ভালো কিছু উপহার দেবেন।

এনএ