বাড়ির সামনে, উঠানে ও রাস্তার পাশে কেউ শণ-খড় পরিষ্কার করছে, কেউ সংরক্ষণের জন্য খড়ের গাদা (পালা) দিচ্ছে, কেউ কেউ ঝাড়ু বা বারুন তৈরির কাজে ব্যস্ত। তবে নানা সংকট আর দুর্দিনের মাঝেও পূর্বপুরুষের এ শিল্পকে ধরে রাখতে সদা ব্যস্ত।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের এলংগী পাড়া গ্রাম ঘুরে এই চিত্রই ফুটে উঠেছে। তবে ঝাড়ুশিল্পের শত বছরের ঐতিহ্য থাকলেও মেলেনি তাদের কুটিরশিল্প হিসেবে বিসিকের স্বীকৃতি। এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। ফলে তাদের ভাগ্যের বদলও ঘটেনি।

নানা প্রতিকূলতা ও কালের ব্যবধানে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পকর্ম ঝাড়ুশিল্প। অর্থনৈতিকভাবে অপার সম্ভাবনার রয়েছে এ শিল্পের। কেবল সরকারি সহযোগিতার পেলে শিল্পোদ্যোক্তা বৃদ্ধি, বেকার সমস্যা সমাধান এবং অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা পাবে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না। ঝাড়ুশিল্পের সাথে যুক্ত পরিবারগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

তারা বলেন, কুষ্টিয়ার ঝাড়ুশিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ঝাড়ুশিল্পের প্রতি সরকারের সহযোগিতা এবং বিসিকের স্বীকৃতি পেলে কুমারখালীর হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সেসব পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। সাথে সাথে এই এলাকার অর্থনীতি হবে আরও সমৃদ্ধ। ঝাড়ুশিল্প থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়ের সুযোগও রয়েছে। সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করছে। সরকার সহযোগিতা করলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বংশপরম্পরায় বাপ-দাদাদের ঝাড়ুশিল্পের পেশাকে ধরে রেখেছে এলংগী পাড়ার ব্যবসায়ী ও কারিগররা। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও শত বছর ধরে শতাধিক পরিবার ঝাড়ুশিল্পকে সন্তানের মতোই বুকে আগলে রেখেছেন। আগে হাজারো পরিবার এই শিল্পের সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে শতাধিক পরিবারে। আবার যে পরিবারগুলো বর্তমানে এই পূর্বপুরুষদের কর্মটি ধরে রেখেছে, তাদেরও নানা সমস্যা। সংসারের স্কুলপড়ুয়া সন্তান থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও সারা দিন এ কাজে নিয়োজিত থাকেন। কারণ তাদের আয়ের উৎস এই ঝাড়ুশিল্পী।

ঝাড়ুশিল্প ব্যবসায়ী ও কারিগর ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঝাড়ু তৈরির প্রধান কাঁচামাল শণখড় এখানকার কারিগরদের দূরদূরান্ত থেকে কিনে আনতে হয়। বছরের চৈত্র, বৈশাখ মাসসহ মাত্র কয়েক মাস পর্যাপ্ত শণখড় পাওয়া যায়। কিন্তু সারা বছর কাজ চলমান রাখার জন্য খড় কিনে মজুত রাখতে হয়।

তিনি আরও বলেন, এখানকার কারিগররা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় পর্যাপ্ত খড় কিনে মজুত করতে পারে না। অনেকে বেসরকারি বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কাঁচামাল সংরক্ষণ করে। কিন্তু সেখানে অধিক সুদ হওয়ায় প্রতিবছর ঋণ নিয়ে কাঁচামাল মজুত করা সম্ভব হয় না। সরকারের কাছে আমার দাবি, সরকার যেন আমাদের ঋণের ব্যবস্থা করে।

ঝাড়ু তৈরির কারিগর হালিমা খাতুন বলেন, আমি অন্যজনের বাড়িতে শণখড় পরিষ্কারের কাজ করি। কাজের বিনিময়ে নষ্ট খড় পায়। তা জ্বালানি খড়ি হিসেবে ব্যবহার করি। খুব কষ্টের কাজ। আমাদের মতো অনেক মানুষ এই কাজের সাথে যুক্ত।

বুলবুলি খাতুন বলেন, ফরিদপুর, পাবনা, ঢাকা, পিয়াজখালীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে খড় কিনে নিয়ে আসি। সেই ঘর থেকে আমরা ঝাড়ু তৈরি করি। এলংগী পাটা এলাকায় ঝাড়ু রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, মেহেরপুর, রাজবাড়িসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। পরিবারের সবাই মিলে সারা দিন ধরে আমরা এই কাজ করি। আর এই আয়ের টাকা দিয়ে কোনোরকমে আমাদের সংসার চলে। প্রতিটি ঝাড়ু তৈরি করতে ৫ থেকে ৬ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি ঝাড়ু পাইকারি বিক্রি হয় ৭ থেকে ৮ টাকা। তবে খুচরা বিক্রি করলে ১৫ থেকে ২০ টাকা পাওয়া যায়। ঝাড়ু বিক্রি করার জন্য যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, দর্শনাসহ দূরদূরান্তে যেতে হয়।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র নাইম আলী ঢাকা পোস্টকে বলে, দরিদ্র ঘরে আমার জন্ম। পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা থাকার কারণে পড়ালেখার পাশাপাশি আমি ঝাড়ু তৈরির কাজ করি। স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে এই কাজ করি। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়। সে টাকা দিয়ে আমাদের সংসার এবং আমার লেখাপড়ার খরচ চলে। প্রায় তিন বছর ধরে আমি এই কাজের সাথে যুক্ত।

ব্যবসায়ী আকাশ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বহু বছর ধরে ঝাড়ু তৈরির কাজ করে আসছে আমাদের গ্রামের পূর্বপুরুষরা। এখন আমি বাপ-দাদাদের পেশায় যুক্ত। আমার মতো ১৫০ থেকে ২০০ পরিবার এই পেশার সাথে যুক্ত। এই ঝাড়ুর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু অর্থের অভাবে আমরা ভালোমতো ব্যবসা করতে পারি না। সরকারি সহযোগিতা ও অর্থের অভাবে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে৷ সরকারিভাবে ঋণ-সুবিধার ব্যবস্থা করলে এই ব্যবসায় অনেক সফলতা আসত। সরকারের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানাচ্ছি।

ববিতা খাতুন বলেন, আমরা এনজিও থেকে সুদ নিয়ে ব্যবসা করি। সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। সরকার ঋণের ব্যবস্থা করলে আমরা আরও ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়ার জন্য অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মন্ডল বলেন, শতাধিক পরিবার শত বছর ধরে এলংগী এলাকায় ঝাড়ু তৈরির কাজ করছে। উদ্যোক্তার খোঁজে এলাকা ও তাদের কাজ পরিদর্শন করেছি। তাদের ভাগ্যবদলে ও কাজটিকে আধুনিক করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।

বিসিক জেলা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সোলায়মান হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তাদের সাথে কথা বলেছি। সরেজমিনে ঘুরে দেখেছি। ঝাড়ুশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারিভাবে তাদের সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাদের কোনো সংগঠন নেই। আমি তাদের একটি সংগঠন তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। পরে তারা আর আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

এনএ