গহিন অরণ্যের লীলাভূমি খাদিমনগর উদ্যান
‘রেইনফরেস্ট’ নামে খ্যাত সিলেটের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানটি (Khadimnagar National Park) শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে। নগরের খুব কাছেই গহিন এ অরণ্যের চারপাশ সবুজ ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। নগরের যান্ত্রিক কোলাহলমুক্ত এ উদ্যানটি বর্তমানে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে স্থান করে নিয়েছে। আর দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এখানে ঘুরতে আসেন প্রতিনিয়ত।
২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হওয়া এ উদ্যানে রয়েছে ৬৭৮ দশমিক ৮০ হেক্টর (১৬৭৭ একর) জমি। সিলেট বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিলেট উত্তর রেঞ্জ-১ এবং খাদিমনগর বন বিটের আওতাভুক্ত এ অরণ্যে রয়েছে আকর্ষণীয় বেত-বাঁশসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং বিরল পশুপাখির আবাসস্থল। ৬টি চা-বাগানের মধ্যে অবস্থিত খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের পূর্বে রয়েছে ছড়াগাং চা-বাগান, হবিবনগর চা-বাগান; পশ্চিমে বুরজান চা-বাগান, কালাগুল চা-বাগান; উত্তরে গুলনী চা-বাগান এবং দক্ষিণে রয়েছে খাদিম চা-বাগান।
বিজ্ঞাপন
বন বিভাগের তথ্যমতে, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে প্রায় ২১৭ প্রজাতির গাছ এবং ৮৩ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছ সেগুন গাছ, ঢাকি জাম, গর্জন, চম্পা ফুল, চিকরাশি, চাপালিশ, মেহগনি, শিমুল, চন্দন, জারুল, আম, জাম, কাউ, লটকন, বনবড়ই, জাওয়া, কাইমুলা, গুল্লি, পিতরাজ, বট, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, মান্দা, পারুয়া, মিনজিরি, অর্জুন, একাশিয়া প্রভৃতি। বাঁশের প্রজাতিগুলোর মধ্যে জাইবাশ, বেতুয়া বাঁশ, পেঁচা বাঁশ, পারুয়া বাঁশ এবং বেতের প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে তাল্লাবেত, জালিবেত।
বিজ্ঞাপন
শুধু গাছ আর উদ্ভিদই নয়, এ উদ্যানে প্রাণীদের মধ্যে আছে দোয়েল, ময়না, শ্যামা, কাক, কোকিল, টিয়া, কাঠঠোকরা, মাছরাঙা, চিল, ঘুঘু, বক, টুনটুনি, চড়ুই, বুলবুলি, বনমোরগ, মথুরা, শালিক। স্তন্যপায়ীর মধ্যে রয়েছে বানর, হনুমান, শিয়াল, বনবিড়াল, বেজি, কাঠবিড়াল, ইঁদুর, খরগোশ, মেছো বাঘ।
সাপের মধ্যে আছে অজগর, দারাইশ, উলুপুড়া, চন্দ বুড়াসহ নানা বিষধর সাপ।
খাদিম উদ্যানে টুরিস্ট গাইডের দায়িত্বে থাকা শৈলেন দেব ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে আসা পর্যটকদের যাতে কোনো রকম সমস্যা না হয়, সে জন্য আমরা সার্বক্ষণিক তাদের গাইড দিয়ে থাকি।
এই উদ্যানে টুরিস্টদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ট্রেইল অ্যাকটিভিটি, ট্রি অ্যাকটিভিটিজ, জিপ লাইনিং, তাঁবুতে রাতযাপন ও ঘন জঙ্গলে ঘণ্টাব্যাপী ট্রেইলিং।
ট্রেইল অ্যাকটিভিটি
খাদিমনগরে হাঁটার জন্য ৪৫ মিনিট ও দুই ঘণ্টার দুটি ট্রেইল আছে। বন বিভাগের বিট অফিসের সামনে ট্রেইল দুটির মানচিত্র দেওয়া আছে, এ ছাড়া স্থানীয় কাউকে গাইড হিসেবে সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে। যদি ঘন জঙ্গলে ট্রেকিং করতে চান, তাহলে সঙ্গে গাইড নেওয়া ভালো। এক ঘণ্টার গাইড খরচ ১৫০ টাকা। ঘন জঙ্গলে বাহারি গাছপালা ও পশুপাখিদের কলরবে ট্রেকিং করতে ভালোই লাগে।
জিপ লাইন
বিট কর্মকর্তার অফিসের সামনেই আছে জিপ লাইন। জিপ লাইনে ওঠার আগে আপনাকে অবশ্যই নিরাপত্তা অবলম্বন করতে হবে।
ট্রি অ্যাকটিভিটিজ
ট্রি অ্যাকটিভিটি করতে হলে কেডস জুতা পরা ভালো। পরিবার নিয়ে এখানে ঘুরতে আসতে পারেন। সবার জন্য এটা নিরাপদ জায়গা আর স্থানীয়রা খুব আন্তরিক। তবে হৃদরোগীদের ট্রি অ্যাকটিভিটি না করা ভালো কারণ এটি করতে যথেষ্ট সাহস লাগে। বেল্ট, হেলমেট এবং ক্লিপ দ্বারা লাইনে যুক্ত থাকে শরীর।
তাঁবুতে রাতযাপন
তাঁবুতে রাত যাপন করতে চাইলে তাঁবু ভাড়া করা যায়। বিট অফিসে যোগাযোগ করলে তাঁবু করে রাতযাপনের ব্যবস্থা করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হবে তাদের সঙ্গে।
রেইনফরেস্টের সামনে দিয়ে উত্তর দিকে এয়ারপোর্ট-হরিপুর সড়ক। সেখান দিয়ে আবার রাতারগুল সোয়াম্পফরেস্টে যাওয়া যায়। আপনি যদি এক দিনের জন্য সিলেট ঘুরতে চান, সে ক্ষেত্রে এ পথটি ব্যবহার করে চা-বাগান, রেইনফরেস্ট, সোয়ামফরেস্ট দেখে যেতে পারেন।
গহিন এ অরণ্যে আসা পর্যটক শরীফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি জিপ লাইনিং করে খুব আনন্দ পেয়েছি। নিরিবিলি পরিবেশে আনন্দ করার জন্য যে কেউ এখানে পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসতে পারেন। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার জন্য এ রকম জায়গা খুব কমই পাওয়া যায়।
পর্যটকদের নিরাপত্তা ও আবাসনের বিষয়ে জানতে চাইলে উদ্যানের দায়িত্বে থাকা সহব্যবস্থাপনা নির্বাহী কমিটির হিসাবরক্ষক ও প্রশাসনিক সহকারী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির ঢাকা পোস্টকে জানান, এ রকম মনোরম পরিবেশ খুবই কম জায়গায় রয়েছে। বন বিভাগের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখানে সার্বক্ষণিক পর্যটকদের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। তাদের থাকার জন্য এখানে কটেজ ও তাঁবু রয়েছে।
কীভাবে যাবেন
সিলেট নগরীর বন্দরবাজার থেকে খাদিমনগর উদ্যানে যাওয়ার জন্য মাইক্রোবাস বা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিতে পারেন। সিলেট নগরী থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বে খাদিম চৌমুহনী যাওয়ার পর বাম দিকের ছোট পাকা রাস্তা ধরে আপনাকে সামনে এগোতে হবে। পিচ, ইট বিছানো ও কাঁচা রাস্তা মিলিয়ে আপনাকে আরও ৫ কিলোমিটার ভেতরে যেতে হবে।
মাইক্রোবাসে যাতায়াত খরচ পড়বে ১০০০ টাকার মতো, আর অটোরিকশার ভাড়া হবে ৫০০ টাকার মতো। আর লোকাল সিএনজি অটোরিকশাতে গেলে বন্দরবাজার থেকে জনপ্রতি ৮০ টাকা পড়বে।
এনএ