প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাভারের একটি ইউনিয়ন বিরুলিয়া। যেখানে একরের পর একর সরকারি জমি রয়েছে। আর এই জমির পেছনে লেগেছে একটি চক্র। নবাবের উত্তরসূরি দাবি করে দানপত্র দলিলের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে এই জমি। আর কম দামে পেয়ে প্রতারিত হচ্ছেন শত শত মানুষ। ইতোমধ্যে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

খোজঁ নিয়ে জানা যায়, চক্রটির মূলহোতা হিসেবে কাজ করছে মাসুদ নামে এক ব্যক্তি। তিনি বরিশালের বাসিন্দা। সাভারের আশুলিয়ার আউকপাড়া এলাকায় ভাড়া থাকেন তিনি। আক্কাস, আবুল হাসান, এমরান, হাফিজসহ ১৯ জনের সহযোগিতায় সহজেই প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের ছোট কালিয়াকৈর মৌজায় সরকারি ২৪৭ একর জমি রয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি সংস্কার বোর্ড, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের আওতাধীন সিএস খতিয়ান ৬ এর অন্তর্ভুক্ত। আর এসব জমিই প্রতারণার মাধ্যমে নবাবের জমি দাবি করে প্লট আকারে বিক্রি করছে চক্রটি। এখানে নবাব পল্লি নামে গড়ে তোলা হবে একটি পল্লি। নির্মান করা হবে ৬৪ তলা বঙ্গবন্ধু ভবন। আর এই ভবন নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় আক্কাস আলী।

৩ শতাংশ, ৫ শতাংশ ও ১০ শতাংশের প্লটে বিভক্ত করে জমির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তিন শতাংশের দাম ৫০ হাজার, ৫ শতাংশ ১ লাখ ও ১০ শতাংশ ১০ লাখ টাকা। পরিমাণ অনুযায়ী জমির টাকা পরিশোধ করা হলে ৩০০ টাকার একটি স্ট্যাম্পে খাজা সাইফুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি  দানপত্র দলিল দেওয়া হচ্ছে। খাজা সাইফুল্লাহর ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ২১ নম্বর সড়কের ২৭ নম্বর বাড়ি। তার বাবার নাম নবাবজাদা খাজা হাফিজউল্লাহ্। প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি এমন দলিলে জমি কিনে প্রতারিত হয়েছেন।

সাভারের গেন্ডা এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগী হারুন-উর-রশিদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে সাভারে ভাড়া থেকে বসবাস করছি। কিছু দিন আগে পূর্বপরিচিত হাফিজ নামে এক ব্যক্তি ৫০ হাজার টাকায় নবাবদের তিন শতাংশ জমি কেনার প্রস্তাব দেন। পরে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে প্রায় এক মাস আগে ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর তার সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রতিবেদকও তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

নড়াইলের বাসিন্দা হোসেন নামে এক মাদরাসা শিক্ষক বলেন, কয়েক মাস আগে মাসুদ ও তার সহযোগীরা আমাকে জমি কেনার প্রস্তাব দিলে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়ে তিন শতাংশের পাঁচটি প্লট ক্রয় করেছি। তাদেরকে টাকা দেওয়ার পর তারা আমাকে নবাবদের বংশধর খাজা সাইফুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির স্বাক্ষরিত দানপত্র দলিল দিয়েছে। তবে এখনও জমি বুঝিয়ে দেননি। এখন মনে হচ্ছে তাদেরকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছি।

শুধু হারুন আর হোসেন নয়, এমনিভাবে প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি কম টাকায় জমির লোভে  প্রতারকের খপ্পড়ে পড়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, আশুলিয়ার আউকপাড়ার বাসিন্দা আবুল হাসান আমাকে বেশ কয়েক বার জমি কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সাভারের বিরুলিয়ার ছোট কালিয়াকৈর মৌজায় নাকি অনেক জমি রয়েছে নবাবদের। নবাবের বংশধরই বিক্রি করছেন এই জমি। আর ওই জায়গার নাম হবে নবাব পল্লি, এছাড়া ওই স্থানের পাশে ৬৪ তলা বঙ্গবন্ধু ভবন নির্মাণ করা হবে। যার দায়িত্বে রয়েছেন চক্রের সক্রিয় সদস্য স্থানীয় আক্কাস আলী।

আক্কাস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা অনেক বছর ধরে এই সরকারি জমি ভোগ দখল করে আসছি। প্রায় সময় সাহেবরা এসে তাদের জায়গা দাবি করে। সম্প্রতি কিছু লোক এসে আমাকে বলেছে এখানে ৬৪ তলা বঙ্গবন্ধু ভবন নির্মাণ করা হবে। ভবন তারাই নির্মাণ করবে, আমি এর সঙ্গে জড়িত না। 

সরকারি জমি বিক্রির ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি তো বিক্রি করছি না। বিক্রি করছেন আশুলিয়ার আউকপাড়ার বাসিন্দা মাসুদ নামে এক ব্যক্তি।

চক্রের মূলহোতা মাসুদ বলেন, নবাবদের বংশধররা সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় ছোট কালিয়াকৈর মৌজায় তাদের জমি বিভিন্ন মানুষকে দান করছেন। বিক্রি তো করা হচ্ছে না। এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক মানুষকে প্লট আকারে জমি দান করা হয়েছে। আমার সঙ্গে স্থানীয় আক্কাসসহ আরও অনেকে রয়েছেন। আমরা মিডিয়া হিসেবে কাজ করছি।

টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, নবাবদের বংশধররা দলিলের খরচ বাবদ আমাদের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। এর চেয়ে বেশি দলিল গ্রহীতাদের কাছ থেকে কেউ নিয়ে থাকলে আমি তা জানি না। নবাবের বংশধরের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে বললে অপারগতা প্রকাশ করেন মাসুদ। 

এ বিষয়ে সাভারের আমিনবাজার রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাখী ছেপ বলেন, ওই জমি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের। এর মধ্যে কিছু জমি নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এসব জমি  বিক্রি বা দান করার এখতিয়ার কারও নেই।

সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরো সাভার উপজেলায় বঙ্গবন্ধু ভবন নামে ৬৪ তলা ভবন নির্মানের খবর আমার জানা নেই। আর সরকারি জমি কেউ বিক্রি করতে পারে না। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আরএআর