কুড়িগ্রাম জেলার সাড়ে ৪ শতাধিক চরাঞ্চলসহ অবহেলিত এলাকার মানুষের আইনি সেবা সহয়তায় প্রায় এক মাস আগে জেলা জজ আদালতে চালু হয়েছে অনলাইন আইনি তথ্যসেবা কেন্দ্র। এরই মধ্যে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের এ তথ্যসেবা কেন্দ্রের সুবিধা পেতে শুরু করেছে এখানকার নির্যাতিত ও আইনি সেবা নিতে আসা হয়রানির শিকার হওয়া মানুষজন।

যৌতুক না দিতে পেরে ধারাবাহিক নির্যাতন শেষে স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম সদর এলাকার কোহিনূর আক্তার। বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া কোহিনূরের কাছে পাঠানো হয়েছে তালাকের কাগজও। নিরুপায় হয়ে ন্যায় বিচার পেতে এসেছেন কুড়িগ্রাম জেলা জজ আদালতে। কিন্তু কী করবেন, কীভাবে শুরু করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। একসময় কোহিনূর আক্তার খবর পান এই সেবাকেন্দ্রের।

এই ভুক্তভোগী জানান, ফ্রেন্ডশিপ অনলাইন আইনি তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর পর এখন সমাধানের জন্য রাজি হচ্ছেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ফলে জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন কোহিনূর। তিনি জানান, এসব আইনি প্রক্রিয়ায় লাগেনি কোনো খরচও।

কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার বাসিন্দা রহিমা বেগম দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উত্তরাধিকার সম্পত্তি উদ্ধারে। মামলার সুরাহা করতে এ পর্যন্ত পরিবর্তন করেছেন ৭ জন আইনজীবী। প্রতিপক্ষের প্রভাবে নিজের উকিলের কাছেও হেনস্তার শিকার হয়েছেন রহিমা। হতাশায় ডুবে থাকা রহিমা ফ্রেন্ডশিপ অনলাইন আইনি তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের সহযোগিতায় এখন অনেকটাই আশাবাদী তিনি।

কুড়িগ্রাম জেলা জজ আদালতে প্রায় এক মাস চালু হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ অনলাইন আইনি তথ্য ও সেবা কেন্দ্র। এরই মধ্যে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের সেবা।

এখানকার কর্তব্যরত প্যারালিগ্যাল এনামুল হক জানান, বিনা খরচে এবং অল্প সময়ে সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় বলে সেব গ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। তিনি আরও জানান, ফ্রেন্ডশিপ অনলাইন আইনি তথ্য ও সেবা কেন্দ্র সবার জন্য উন্মুক্ত।

তবে এখানকার অভিযোগের ৭০ ভাগই স্বামী-স্ত্রী বা পারিবারিক বিরোধ সংশ্লিষ্ট। বাকি সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, জমিজমা বা পাড়া-প্রতিবেশী বিরোধ। সেবাকেন্দ্র সম্পর্কে এই প্যারালিগ্যাল বলেন, এখানে অভিযোগকারী এলে প্রথমে একটি আবেদন ফর্মে তাদের স্বাক্ষর নিয়ে আইনি কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় তারা ঘরে বসে মামলা বা সালিসের তারিখ পান এসএমএসের মাধ্যমে।

ফ্রেন্ডশিপের সহকারী পরিচালক আহমেদ তৌফিকুর রহমান জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের অর্থনৈতিক সংকট এতটাই বেশি যে পরিবারের খাবার জোগানো তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। সেখানে আইনি সহয়তার জন্য খরচ করা তাদের পক্ষে খুবই কঠিন। প্রান্তিক এলাকার মানুষের মাঝে রয়েছে শিক্ষার অভাব। ঠিকমতো যোগাযোগের অভাবে তারা প্রায়ই দালাল বা খারাপ লোকের খপ্পরে পড়ে যায়। প্রত্যন্ত এলাকার বিশেষ করে চরাঞ্চলের বাসিন্দারা উপযুক্ত যোগাযোগ ও সক্ষমতার অভাবে জেলা আদালতে যেতেও উৎসাহিত হন না। ফলে ন্যায় বিচার বা ন্যায্য অধিকার থেকে বিতাড়িত হন অনেকে।

তিনি বলেন, জেলা আদালত ভবনে স্থাপিত আইনি তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে বঞ্চিত সেসব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। কুড়িগ্রাম জেলা জজ আদালতে আইনি সহায়তা কেন্দ্র বা লিগ্যাল বুথ স্থাপনের সুযোগ দেওয়ায় জেলা লিগ্যাল এইডকেও ধন্যবাদ জানান ফ্রেন্ডশিপের এই কর্মকর্তা।

উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের জ্যেষ্ঠ পরিচালক ব্যারিস্টার আয়েশা তাহসিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ চরাঞ্চলে বসবাস করে। তাদের পাশাপাশি কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দাদের জন্য জেলা আদলত ভবনে চালু করা হয়েছে ফ্রেন্ডশিপের ‘অনলাইন আইনি তথ্য ও সেবা কেন্দ্র’। ফলে অনলাইন বা অফলাইনে সব ধরনের আইনি সেবা পাবেন কুড়িগ্রাম জেলার চরাঞ্চলসহ অবহেলিতা এলাকার বাসিন্দারা।

এই সেবা চালু হওয়ায় প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করছেন জেলার আদালত-সংশ্লিষ্টরা। আদালতে আইনি সেবা প্রাপ্তিতে ফ্রেন্ডশিপের এমন উদ্যোগের প্রশংসাও করেছেন ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’র পরিচালক, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং কুড়িগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যানসহ অনেকে।

এনএ