‘আমার বাবায় আমাগোরে কামাই কইরা খাওয়াইতো। আমরা তিনডা ভাই একটা বইন মাঝারো, আমরা দুইডা ভাই একসাথে কলেজে পড়ি। ছোড বইন পরীক্ষা দিছে এবার এইটে। দেনা কইরা আমাগো পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করছে। আমাগো পরীক্ষার টাইম হইয়া গেছে ৯ তারিখে, বাবায় কইছে নদীর তনে আইয়া আমাগোরে কিছু টাকা পয়সা দিবো পরীক্ষার জন্য। বাবায় কইছে আমাগো পরীক্ষার সময় বাড়িতে থাকবো। বাবার আয়ে আমাগো সংসারডা চলে, আমরা পড়ালেখা করি কাজ তো আর করতে পাড়ি না। এহন তো বাবারে পাই না। যেভাবে হোক জীবিত কিংবা আর মৃত আমার বাবারে চাই।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের কলিমোল্লা মলিসাহেব বাড়ির নিখোঁজ মো. ইউসুফের ছেলে সাইদুল। 

শুধু সাইদুলই নয় মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) সরেজমিনে চরফ্যাশন উপজেলার আবদুল্লাহপুর ইউনিয়ন ৪ নং ওয়ার্ডের উত্তর সিবা গ্রামে ট্রলার মালিক কামাল খন্দকার ও তার ভাই ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া হাফেজ মিস্ত্রির বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের কান্না আর আহাজারি দেখা গেছে। 

বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলারডুবির তিন দিন পার হলেও চরফ্যাশন উপজেলার আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের নিখোঁজ ২০ জেলের সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজ ওই ২০ জেলের পরিবারে চলছে মাতম। তবে জেলেদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

ওই এলাকার রুহুল আমিন সর্দার বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়ের জামাই সুমন জেলের কাজ করে। প্রতিদিনের মতো ওই দিন সাগরে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু আজকে দুই দিন পর শুনতেছি সাগরে তাদের ট্রলারে আরেকটি ট্রলার ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিছে। এহনও আমার জামাইয়ের কোনো খোঁজ খবর পাইনি, আছে না মরছে তাও জানি না। আমার দেড় বছরের একটা নাতিকে এক কথায় এতিম বানায়া থুইয়া গেছে।’

কথা হয় নিখোঁজ আব্দুল খালেকের স্ত্রী রেখা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গেছে বুধবার রাইতে আমার স্বামীরে সাগরে নেওয়ার লইগা বোডের মাঝিরা ১০-১৫ বার ফোন দিছে। পরে বাড়িত আইছে, সে যায় নাই। পরদিন রাতরে ছাইড়া আবার চর-মন্তাজ গেছে। সেখান থেকে ফোন দিছে, বলছে চর-মন্তাজ ঝড় চলে, ঝড় কমলে আমরা সাগরে যাম, আইতে ২-৪ দিন দেরি হবে। কাইল দুপুরে আমার দেবরে খবর দিছে হেগো বোট সাগরে মাইর খাইছে, জাহাজে কোনো লোক পায় না। সে যাওনের দিন কইছে, এই শেষ বারের মতো আইয়া আর যামু না বোট বাইতে।’

আদরের ছোট ভাই জসিমকে হারিয়ে মো. নাসিম বলেন, ‘আমার একমাত্র ভাই কাউরে কিছু না বলে সাগরে গেছে। এহন পর্যন্ত তাকো কোনো খোঁজ খবর পাইতেছি না।’

সাগরে ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলে- বাচ্চু মাঝি, ফারুক, জাভেদ, আলামিন, মালেক, ইউসুফ, জলিল, রফিক, মাসুদ, বাচ্ছু, নুরুল ইসলাম, হারুন, নুর আলম, বাশার, সুমন, শাহিন, দীন ইসলাম, নাগর মাঝি ও জসিম। তারা উপজেলার আব্দুল্লাপুর, জাহানপুর, নীল কমল ও ভোলা সদরের ইলিশা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। 

আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আল এমরান প্রিন্স জানান, নিখোঁজ জেলেদের পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে  সহযোগিতা করা হবে। নিখোঁজ জেলেদের জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় উদ্ধারের জন্য নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জোর তৎপরতার দাবি জানান তিনি। 

ট্রলার মালিক কামাল খন্দকার ও জীবিত উদ্ধার হয়ে ফিরে আশা হাফেজ মিস্ত্রিকে বাড়িতে দেখতে এসে চরফ্যাশন উপজলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল নেমান বলেন, নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারের জন্য কোস্টগার্ড গভীর সমুদ্রে চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এখনো ঢালচর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

তিনি আরও জানান, এসএল আর-৫ নামের একটি ট্রলারের ধাক্কায় এই ট্রলারটি ডুবে গেছে। ওই ট্রলারের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। পুলিশকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলা হয়েছে। এছাড়াও নিখোঁজ জেলেদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত রোববার (৫ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১০টার দিকে মাছ ধরা শেষে ফেরার পথে ঢালচর ইউনিয়নের চরের নিজামের দক্ষিণ পূর্বদিকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সাগর মোহনায় একটি ট্রলারে ধাক্কা লেগে ২১ জেলে নিয়ে কামাল খন্দকারের মা সামসুর নাহার নামের মাছ ধরার ট্রলারটি ডুবে যায়। এতে এক জেলে উদ্ধার হলেও নিখোঁজ রয়েছেন ২০ জেলে।

ইমতিয়াজুর রহমান/আরএআর