যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম

‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত। সেই রাতে হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। চারদিকে রক্তের গন্ধ। পাকিস্তান বাহিনীর গুলিতে ঝাঁঝরা নারী-পুরুষদের মরদেহ এদিক-সেদিক পড়ে ছিল। এমন দৃশ্য চোখের সামনে বারবার পড়লে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারিনি। এরপরই চুয়াডাঙ্গার হাজার হাজার মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।’

এভাবে রণাঙ্গনের রোমহর্ষক বর্ণনা ঢাকা পোস্টের এই প্রতিনিধিকে জানালেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনে অনুপ্রেরণা আর বাবার কাছ থেকে বিদায় শেষে যুদ্ধে যাওয়ার মনস্থির করি।

তখন আমার বয়স ২৪ বছর। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের মার্চের মাঝের দিকে। সেদিন সর্বপ্রথম চুয়াডাঙ্গায় বিমানযোগে পাকবাহিনী হানা দেয়, সেই দিন আমার বাবা সৈয়দ আলীর কাছ থেকে বিদায় নিই। ৯ মাস যুদ্ধের পর জয়ী হয়েই ফিরে আসি বাবার ছায়াতলে।

কোথায় কার অধীনে ট্রেনিং

সিরাজুল ইসলাম বলেন, দামুড়হুদার পরানপুর গ্রামে আমার জন্ম। যুদ্ধের জন্য বিদায় নেওয়ার সময় বাবার কাছে কোনো টাকা ছিল না। ছোট্ট একটি টিন সরিষা দিয়ে আমাকে বিদায় দিল বাবা। মাইলের পর মাইল হেঁটে দর্শনা চেকপোস্ট দিয়ে ভারতের গেদে স্টেশনে পৌঁছায়। সেখানে একটি খাবার হোটেলে অ্যাডভোকেট ইউনুচ আলী ও হাসেম আলীর সঙ্গে দেখা হয়। কিছু খাবার খেয়ে তাদের সঙ্গে ট্রেনযোগে আমরা চলে যাই মাজদা ইয়ুথ ক্যাম্পে। যোগদানের তারিখটা আমার মনে নেই।

সেখানে সরকারিভাবে ভাড়ায় একটি গোডাউনে আমরা কয়েকজন ২৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষ করি। সেখানে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর, এসএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ার অধীনে হায়ার ট্রেনিং শেষ করার পর বানপুর ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মনজুর আহমেদের কাছে হাজির হই। পরে বানপুর ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান) নেতৃত্বে যুদ্ধে অশংগ্রহণ করি।

সেক্টর ও যুদ্ধক্ষেত্র

৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুরের অধিকাংশ এলাকা ও দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশ নিয়ে ছিল এ সেক্টর। এই সেক্টরে থেকে আমি যুদ্ধে নামি। এরমধ্যে জীবননগর থানার ধোপাখালী মসজিদের মধ্যে পাকবাহিনীর সৈন্যরা অবস্থান করছে এমন সংবাদ পেয়ে বানপুর ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে আমিসহ একদল তরুণ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।

১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিটে দিকে দুপক্ষের গোলাগুলির সময় ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের পেটে একটি গুলি লাগে। ক্যাপ্টেনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার বাম হাতে একটি গুলি লাগে। পরে সহযোদ্ধারা আমাদের দুজনকে উদ্ধার করে ভারতের কৃষ্ণনগর হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে টানা এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আবারও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

রণাঙ্গনের রোমহর্ষক স্মৃতি

বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বলেন, অপারেশনটা ছিল খুবই শ্বাসরুদ্ধকর। সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে পাকবাহিনীর সৈন্যরা আসছে। এমন নির্দেশনা পেয়ে আমিসহ সহযোদ্ধারা তাদের প্রতিহতের প্রস্তুতি নিই। সেদিন রাতে চুয়াডাঙ্গার অভিমুখে আসবে ট্রেনটি।

পরে চুয়াডাঙ্গার জীবনগরের উথলী সেনেরহুদায় সেন্টার স্থাপন করে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। ওই রাত পৌনে ৮টার দিকে ট্রেনটি সেন্টারের নিকট পৌঁছালে আমি বোমা মেরে ট্রেনটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।

পরে জানতে পারলাম ওই ট্রেনে ৪০০-৪৫০ পাকসেনা ছিল। এরমধ্যে ২৮০ জন পাকসেনার মৃত্যু হয়। আমি এভাবে দেশকে ভালোবেসে যুদ্ধ করে গেছি। শত্রুকে খতম করে চুয়াডাঙ্গাকে মুক্ত করেই বাড়ির দিকে রওনা হই। ৯ মাস পর বাড়ি পৌঁছালে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।

সহযোদ্ধাদের স্মৃতি ভুলতে পারেনি

যুদ্ধের সময় আমার অনেক সহযোদ্ধা চোখের সামনে গুলিতে ঝাঁঝরা হতে দেখেছি। গুলির বর্ষণে পেছনে না তাকিয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। সেই দৃশ্য মনে পড়লে এখনো আমার বুকটা কেঁপে ওঠে। আমার বন্ধু রবিন, রহিছ স্যার ও শাহারুল ওস্তাদ একসঙ্গেই থাকতাম আমরা। যখন যেখানেই যেতাম আমরা একসঙ্গেই যেতাম।

একদিন একসঙ্গে যাওয়ার সময় পাকসেনারা আমার সামনেই গুলি করে মেরে ফেলেন শারারুল ওস্তাদকে। তখন আমি তাকে ফেলে রেখেই চলে আসি। চোখের সামনে সহযোদ্ধার এই দৃশ্য সহ্য করার নয়। অনেকের সঙ্গে ট্রেনিংয়ে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে জমে থাকা খুনসুটিও মনে পড়লে কাঁদায় আমাকে।

যুদ্ধচলাকালীন স্থানীয়দের ভূমিকা অস্বীকার করার নয়। তারা আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। এমনও দিন ছিল আমরা না খেয়ে থাকতাম। সেটা বুঝতে পেরে স্থানীয় নারীরা আমাদের বাসায় নিয়ে রান্না করে খাওয়াতেন। তাদের বাড়িতে আশ্রয়ও দিতেন। এছাড়াও যখন যা প্রয়োজন হতো বললে তারা সমাধান করতেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা

কিছু কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো অসচ্ছল রয়েছেন। সরকার তাদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করছে। প্রতিমাসে ভাতা দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের শাসনভার নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়েছেন ও সম্মান দিয়েছেন।

চুয়াডাঙ্গা সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১ হাজার ৫৬০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতার আওয়াতাধীন। জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার আবু হোসেন জানান, জেলায় ১৯০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এরমধ্যে ১১০০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।

উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালের ১৮ আগস্ট চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার পরানপুর গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সিরাজুল ইসলাম। জন্মের ৮ মাসের মাথায় তার মায়ের মৃত্যু হয়। তিনি স্থানীয় স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। দরিদ্রতার টানে পড়াশোনা আর এগোতে পারেননি। তিনি বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সবুজপাড়ায় বসবাস করছেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন।

এমএসআর