আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনী যমজ বোন। বাড়ি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়নের সাত ভাইয়াপাড়া এলাকায়। বাঁশের সাঁকো হয়ে তাদের বাড়িতে যেতে হয়। নেই কোনো রাস্তা। এমন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে দুই বোন একসঙ্গে খেলছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে। এখন তারা সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত মুখ। তাদের নিয়ে গর্বিত পরিবার ও এলাকাবাসী।

গতকাল বুধবার (২২ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেই এক গোল করেছেন আনাই মগিনী। তার এক গোল বাংলাদেশের বিজয় এনে দিয়েছে।

কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে দেশের হয়ে ভারতের বিপক্ষে একমাত্র গোলটি করার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন এই নারী ফুটবলার। আনন্দ-উল্লাসে মেতেছেন পরিবারের সদস্য ও গ্রামের বাসিন্দারা। 

আনাই মগিনী খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়নের সাত ভইয়াপাড়া এলাকার রেপ্রু মগের মেয়ে। সাত ভাইবোনের মধ্যে ছোট দুই বোন আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনী। তারা বাংলাদেশ ফুটবল টিমে খেলেন। বাকি দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তিন ভাইও বিয়ে করেছেন।

আনুচিং মগিনী ও আনাই মগিনীর মা-বাবা

স্থানীয় বাসিন্দা মংসাথোয়াই মারমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের হয়ে খেলতে গিয়ে একমাত্র গোল করেছেন আমাদের এলাকার মেয়ে আনাই মগিনী। এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। খেলা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। এ বিজয় সারাদেশের জন্য। আমরা চাই তারা দুই বোন আরও এগিয়ে যাক। 

আনাই মগিনীর বড় ভাই আম্রা মগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বোন গতকাল ভারতের বিপক্ষে খেলে একটি মাত্র গোল করে জয় লাভ করেছে। এটা আমাদের কাছে অনেক আনন্দের একটি বিষয়। আমার বোনের জন্য সবাই আশীর্বাদ করবেন, সে যেন আরও অনেক ভালো খেলতে পারে।

ভাবি রাং মে সু মগিনী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বাড়িতে বসে পুরো খেলা উপভোগ করেছি। অনেক সুন্দরভাবে গোল করেছে সে। আমরা সবাই তখন আনন্দে মেতে উঠেছি। তারা অনেক ভালো খেলে।

বোন ম্রাসাং মগিনী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দুই ছোট বোন বাংলাদেশ টিমে খেলে। তারা  আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের নিয়ে আমরা অনেক সপ্ন দেখি। বিশ্বের সবাই তাদের নাম জানবে। আমাদের এলাকার মানুষ গর্বের সঙ্গে পরিচয় দেবে এরা আমাদের জেলার মেয়ে।

আনাই মগিনীর মা আপ্রুমা মগিনী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কষ্টের সংসারে ছেলে-মেয়েদের তেমন লেখাপড়া করাতে পারিনি। সারাদিন কাজ করে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না। আমাদের দেখার কেউ ছিল না। ছোট দুই মেয়েকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছি। ছোট থেকেই তাদের খেলার প্রতি অনেক আগ্রহ ছিল। খেলতে খেলতে জাতীয় দলে স্থান পেয়েছে। এখন তারা অনেক ভালো খেলে। দেশের সবাই আমার মেয়েদের এখন চিনে। গতকালের খেলার পর সকাল থেকে বাড়িতে অনেক মানুষ আসছে, আনন্দ-উল্লাস করছে সবাই। এতে আমরা অনেক খুশি।

বাবা রেপ্রু মগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা অনেক গরিব। বাড়িতে আসার মতো রাস্তা নেই আমাদের। বাঁশের সাঁকো দিয়ে বাড়ি আসতে হয়। এই জায়গা থেকে আমাদের দুই মেয়ে বাংলাদেশ দলে খেলে এলাকার এবং দেশের সুনাম রক্ষা করেছে। এটা আমাদের সবার জন্য আনন্দের। আমার মেয়েদের জন্য সবাই দোয়া করবেন, তারা যেন আগামীতে আরও ভালো সফলতা অর্জন করতে পারে। দেশ ও এলাকার সুনাম আরও উজ্জ্বল করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমার মেয়েদের যেন সরকার ভবিষ্যতের জন্য কিছু করে দেয়। এটাই আমাদের চাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তাহলে অন্তত তাদের জীবন তারা সাজিয়ে নিতে পারবে। 

খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমা বলেন, আনাই মগিনী খাগড়াছড়ির সন্তান। তার একমাত্র গোলে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা আনাই মগিনীকে অভিনন্দন জানাই। 

প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ১ মার্চ খাগড়াছড়ির সাত ভাইয়াপাড়ায় আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনী জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাইয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে সুযোগ পান তারা। বর্তমানে দুই বোন মহালছড়ি উপজেলার মহালছড়ি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। 

জাফর সবুজ/আরএআর