স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব থেকে আমার বাবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি ছিল, বঙ্গবন্ধুকে তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি আমাদের বলতেন, এই লোকটির মাধ্যমে বাঙালি জাতি মুক্তিলাভ করবে এবং দেশ স্বাধীন হবে। বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণ শুনে বাবা আমাদের তিন ভাইকে ডেকে বলেছিলেন, তোমরা তৈরি হও, তোমাদের পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে এবং তোমাদের ট্রেনিং নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে।

ঢাকা পোস্টের কাছে একান্ত সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা এভাবেই বর্ণনা করেছেন ভোলা সদর উপজেলার জামিরালতা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে আজ থাকছে তার স্মৃতিচারণা।

যুদ্ধে যোগদান ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ
বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং আমরা ঘর ত্যাগ করে প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুতি নেন। ভোলায় সর্ব প্রথম আলী হোসেন নামের এক সেনাসদস্য ভোলার উকিল পাড়ার অবস্থিত টাউন স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তী সময়ে সুবেদার গাজী জয়নাল আবেদিন, ফারুক, বাচ্চু ও ফিরোজ ভাইসহ অন্য আর্মি সুবেদাররা তাদের ভোলা আলিয়া মাদরাসা, সরকারি স্কুল মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাময়িকভাবে একটি বাহিনী মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করেন।

বীর সেনানী শফিকুল বলেন, ট্রেনিং-প্রাপ্ত টিমকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দেন। আমি ছিলাম সুবেদার গাজী জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে ৯ নং সেক্টরে। তারপর থেকে আমরা অপেক্ষায় থাকি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কখন ভোলায় আসবে, কখন আমরা আক্রমণ করব, চারদিকে নজরদারি বাড়াতে থাকি। ১৭ এপ্রিলের দিকে পাক হানাদার বাহিনী ভোলায় আসে, আমরা তাদের প্রতিহত করতে পারিনি, বিভিন্ন বিমানের মাধ্যমে বোমা বর্ষণ করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে পুনরায় সংগঠিত হয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য কঠোরভাবে প্রস্তুতি নিই।

যুদ্ধের লোমহর্ষক স্মৃতিচারণা
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোলার ঘুইংগার হাট ও বাংলাবাজার এলাকায় রাস্তা ঘাটে যাতে কোনো লোক না উঠতে পারে, তাই আমাদের ৬ তরুণ যুবকে দেওয়া হয় সেন্টি ডিউটি। আমরা ওই দিন হাবিব দেওয়ান নামে এক ব্যক্তির কাছে খবর পাই আগামীকাল সকালে নৌ ও স্থল দুই পথে পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অক্রমণ করতে পারে। খবর পাওয়ামাত্রই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি, আমাদের সরঞ্জাম উঠিয়ে ওই এলাকার কাজীবাড়ি নামক স্থানে গুপ্ত অবস্থান নিই এবং ঘুইংগার হাট বাজারে তিনটি এলএমজি-সহ আমাদের টিমের ৬ জন অবস্থান নেয়।

ভোর পাঁচটার দিকে দুই তিনটা মটারের চার্জ এবং লাইট মেশিনগানের গুলি। হঠাৎ এই আওয়াজ শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। এত ভোরে তারা আক্রমণ শুরু করেছে। আমরা তখন ঘুইংগার হাট বাজারের দক্ষিণ পূর্ব পাশে এক রিকশা ওয়ালার বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিলাম। সেখানে আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে পড়ি যে বের হওয়ার কোনো রাস্তাই ছিল না। তিন দিক থেকে হানাদাররা ঘিরে ফেলে। আমরা কৌশলে বের হয়ে আধা কিলোমিটার ধানখেতে হামাগুড়ি দিয়ে ওপার গিয়ে উঠি। ওখানে গিয়ে দেখি মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডারসহ প্রস্তুতি নিচ্ছেন পাক বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য।

তারপর সবাই মিলে প্রস্তুতি নিয়ে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তিন দিক থেকে পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করি। আক্রমণ করলে ওরা বিকেল ৪টার দিকে আমাদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়। পাক হানাদার বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য ও একজন অফিসারকে আমরা গ্রেফতার করি। ঘুইংগার হাট বাজারে আমাদের যে ছয়জন এলএমজি নিয়ে বসে ছিল, তাদের মধ্যে দুজন ওখানেই ওদের গুলিতে শহীদ হয়।

সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্মৃতিচারণা
৫ বা ৬ ডিসেম্বরের দিকে আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রতিটা গ্রুপ চারপাশ থেকে ভোলা টাউনমুখী হতে থাকি। আমাদের গ্রুপের সদস্যরা আলীনগর এলাকার আরিফ পুলিশ নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করি। তিনিও আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। সেখানে আমরা যারা ছাত্র ছিলাম যেমন বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মুমিন টুলু, আমি, রফিকুল ইসলাম, সেলিম জমাদ্দার, মজিবুর রহমান মুজিব, মো. সাদেক, আবু, আবুল কালামসহ আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে অনেক অপারেশন চালিয়েছি। এখনো মাঝেমধ্যে চোখের সামনে সেসব স্মৃতি ভেসে ওঠে।

বর্তমান মুক্তিযোদ্ধারা কেমন আছেন
শফিকুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধে আহত, মুক্তিযুদ্ধে বিধবা পরিবার ছিল। তাদের প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে বঙ্গবন্ধু অনুদান দিয়েছেন এবং বিভিন্ন উপজেলার ইউএনও ডিসিদের মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত হয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতেও ভয় পেতেন তখন।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো। পাশাপাশি নানা অজুহাতে হেয়প্রতিপন্ন করা হতো। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০০ টাকা করে ভাতার ব্যবস্থা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সম্মানের ব্যবস্থা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে ‘গার্ড অব অনার’-এর ব্যবস্থা করেছে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় উন্নীত করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৫০০ থেকে ৯০০ টাকায় করেছে। ফের ২০০৮ সালের পরে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সরকার যখন ক্ষমতা আসে, তিনি একবারে ২ হাজার টাকা করেছেন। পালাক্রমে ৫ হাজার, ৭ হাজার, ৯ হাজার, ১২ হাজার টাকা, আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা পাচ্ছেন। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম ভোলা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি ১৯৫২ সালের ৩ মে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আহমেদ আলী হাওলাদার, মাতা মেহের আবর্জুন। চট্টগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি ভোলা সরকারি স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে এসএসসি, বরিশাল হাতেম আলী কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন। পেশাগতভাবে তিনি একজন ব্যবসায়ী। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভোলা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক কমান্ডার ছিলেন।

২০১০ থেকে ২০১৩ এবং ২০১৪ থেকে তিনি ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দুই ছেলে এক কন্যা সন্তানের জনক তিনি। জ্যেষ্ঠ পুত্র ম্যানেজমেন্টে এমএ, দ্বিতীয় পুত্র কৃষি ডিপ্লোমা বিএসসি পাস করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। একমাত্র কন্যা বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেছেন।

এনএ