আধুনিক সভ্যতার এই যুগে মানুষ যখন অনলাইন গেম কিংবা মাদকের দিকে ঝুঁকছে, ঠিক তখনই মানুষকে বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে ‘বইবৃক্ষ’। যদিও এখনো পর্যন্ত সংগঠনটির কোনো অফিস নেই। বইবৃক্ষের যে বইগুলো আছে তার একটি লিস্ট দেওয়া থাকে এর গ্রুপে। লিস্ট থেকে পছন্দের বইটি বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে কমেন্ট করতে হয়। কমেন্ট দেখে এক দিনের মধ্যে বইবৃক্ষের সমন্বয়করা বিনা মূল্যে পাঠকের বাসায় পৌঁছে দেয় বই। আর চমৎকার এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নাম ‘বইবৃক্ষ’।

বর্তমানে ফেসবুকে এই গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা ১৬ হাজার ৫৫৭ জন। স্থায়ী সদস্য সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে এখন পর্যন্ত বই পড়েছেন ৫ হাজার ১৬১ জন পাঠক।

বইবৃক্ষের উদ্যোগ নেন রমজান আলী (ইমন), খশরু, মেহেদী হাসান, আব্দুর রাফি ও নাসিম রেজা। তবে মহান এ উদ্যোগটির মূল ভূমিকায় রয়েছেন নওগাঁর সাপাহার উপজেলার আশড়ন্দ গ্রামের রমজান আলী। সাপাহার আল হেলাল ইসলামি একাডেমি অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন তিনি। 

বই পড়া এবং সংগ্রহ করা যেন রমজানের নেশা। ছাত্রাবাসে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় ঘোষণা দেন তার কাছে ৩০টি বই আছে। কেউ পড়তে চাইলে দিতে চান, তবে ফেরত দিতে হবে। এরপর থেকেই শুরু হয় বই নিয়ে আলোচনা। বন্ধুরা উপহার দিল আরও ৫০টি বই। তারা বৈঠক করে ঠিক করল বইবৃক্ষ নামে একটি গ্রুপ খুলবেন। এ গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে বই বিনিময় করবে। এভাবেই বইবৃক্ষ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে তার যাত্রা শুরু করে।

ফেসবুক গ্রুপ চালুর পর সাপাহার উপজেলার তরুণ-তরুণীদের বই নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সাড়াও মেলে ভালো। পাঠকদের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় একে একে আশড়ন্দ, নজিপুর, ধামইরহাট, নওগাঁ জেলা সদর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও সবশেষে দিনাজপুরে তাদের শাখা চালু হয়েছে। এ ছাড়াও আগামী বছর আরও ২৮টি শাখা চালু করবে বইবৃক্ষ। 

বইবৃক্ষের প্রতি মাসের পাঠক সংখ্যা ৩৫০ জনেরও বেশি। এখন এই সংগঠনের নিজস্ব বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭৯টি। শিশুদের জন্য ৭টি শাখায় শিশু কর্নার রয়েছে। যে শিশুরা বই পড়তে চায় না তাদের জন্য রিসার্স করে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে চায় তারা। গতকাল নজিপুর সরকারি কলেজ মাঠে একদল তরুণ-তরুণীকে একটি ব্যানার ঝুলিয়ে বইবৃক্ষ নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়। এলাকায় যারা বই পড়তে চায় না তাদের বই পড়ার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। 

নজিপুর সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নোভানা আফরোজ জেরিন জানান, এখন পর্যন্ত দুইশ জনের বেশি মানুষকে বই পড়ার প্রতি আহ্বান করেন ও ৫০ জনের বেশি পাঠকের হাতে বই পৌঁছে দেন তিনি।

আরেক বইপ্রেমী ইসলাম গত বছরের আগস্ট থেকে এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। এরই মধ্যে তার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে ৮০ জন নতুন পাঠক। তিনি বলেন, প্রথমে আমি ভাবতেই পারিনি আইডিয়াটা মানুষকে এভাবে উদ্বুদ্ধ করবে। এত তাড়াতাড়ি সংগঠনের শাখা এতগুলো জেলার এত শহরে ছড়িয়ে পড়বে। আমি এই সংগঠনের হয়ে কাজ করে যেতে চাই।

বইবৃক্ষের সেরা পাঠক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রী সাদিয়া সিনথিয়া জানান, আগে শ্রেণির বই ছাড়া কখনো অন্য বই পড়েননি। বইবৃক্ষের মাধ্যমে তিনি বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এইচএসসি পরিক্ষার পর মাত্র এক মাসে ৩০টি বই পাঠ করেন তিনি। এ বছর তাকে সেরা পাঠক হিসেবে পুরস্কার প্রদান করে বইবৃক্ষ।

বইবৃক্ষের উদ্যোক্তা রমজান আলী জানান, সবার সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে বইবৃক্ষ। সংগঠনটি দাঁড় করানোর জন্য রাজশাহী শহরে তারা সশরীরে কাজ করেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বইপড়ার আন্দোলন এক শহর থেকে অন্য শহরে ছড়িয়ে গেছে। আগামী বছর ওয়েবসাইট চালুর ইচ্ছে রয়েছে তাদের। সাইটে সব শাখা আলাদা থাকবে। যে শাখায় যে বই থাকবে সব বইয়ের তালিকা দেখা যাবে। বইবৃক্ষে যুক্ত হবে দেশের বাইরের ২টি শাখা, চায়না ও অষ্ট্রেলিয়া। এভাবেই ডালপালা মেলতে থাকবে বইপ্রেমীদের এই সংগঠন। কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি। 

মো. দেলোয়ার হোসেন/আরআই